Powered By Blogger

রবিবার, ১১ মার্চ, ২০১২

আমাদের প্রাঞ্জল

আমাদের প্রাঞ্জল


আসাদুল হক খোকন
আমাদের প্রাঞ্জল
পান করে কম জল
কোন কিছু বেশি খেতে চায় না,
কিন্তু সে চঞ্চল
হৈ চৈ কোলাহল
এটা সেটা নিয়ে তার বায়না।

যত তার খেলনা
বেশি তার ফেলনা।

গাড়ি আছে গোটা ছয়
কিছুতেই নেই ভয়
বাঘ, সাপ, সিংহ কি হায়েনা,
যত কর স্নেহ তাকে
খুঁজে ফেরে তবু মাকে
তাকে আর ছেড়ে যেতে চায় না।

বাবা, দাদা, নানু ডেকে
তুলে রাখে বাসাটাকে
চুপটি সে কখনওই রয় না,
বিছানায় ওঠা-নামা
মাঝে মাঝে দেয় হামা
ডাকলে সে কোনও কথা কয় না।

ছুটাছুটি সারাক্ষণ
দৌড়ায় হনহন
মা বলে- এত জ্বালা সয় না।

কাক তার প্রিয় পাখি
করে তাকে ডাকাডাকি
আয় কাক, আয়-আয়,
জানালার খুব কাছে
দোলাদের বাসা আছে
গ্রিল বেয়ে সে বাসায় যেতে চায়।

যদি তার খিদে পায়
বারবার ডেকে যায়
বাবা- দুদু আনো,
মন যদি থাকে ভালো
হাসিতে ছড়ায় আলো
তোমরা কী সে কথাটি জানো?
















বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

লাল সবুজের অহংকার: ‘আমাদের পতাকা আমাদের মান’

লাল সবুজের অহংকার: ‘আমাদের পতাকা আমাদের মান’


আসাদুল হক খোকন
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
ডিসেম্বর মানেই বিজয়ের মাস। আমাদের অহংকার ও স্বাধিকার অর্জনের মাস। এ মাস এলেই মাসজুড়ে তাই আমাদের মনে এক ধরনের চাপা আনন্দ অনুভূতির ছোঁয়া লেগে থাকে। এক ধরনের আবেগ, ক্ষোভ, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় পূর্ণ হয়ে যায় আমাদের হৃদয় গহ্বর! শুধু মনেই নয়, দেশজুড়েই নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে ঘটে এর বহিঃপ্রকাশ। হঠাৎ ডিসেম্বর শুরুর সাথে সাথে আমাদের চারপাশ খুব দ্রুত  লাল-সবুজে রঙিণ হয়ে উঠতে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে এর পরিমান ও পরিধি। আর ১৬ ডিসেম্বর মানেই তখন দাঁড়ায় লাল-সবুজের বন্যায় প্লাবিত বাংলাদেশ!
রাস্তা, শপিং কম্পেøক্স, গাড়িতে, বাড়ির ছাদে, স্কুল -কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে, রিক্সাওয়ালার মাথায়, তরুণ-তরুণীর পোশাকে, শিশুদের গালে- হাতের কব্জিতে, কোথায় নেই লাল-সবুজের ছোঁয়া? কোথায় নেই আমাদের পতাকা? ডিসেম্বর মানেই তাই, লাল আর সবুজের সৌন্দর্যে  জড়ানো আমাদের প্রিয় জন্মভূমি- বাংলাদেশ।

বছর সাতেক হলো অনেকের মতো এমনই লাল-সবুজের মায়ায় জড়িয়ে পড়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মকবুল হোসেনও। ডিসেম্বর এলেই তিনি বেড়িয়ে পড়েন নগরের রাস্তায়। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ, এক হাতে বাঁশের কাঠির মাথায় ছোট ছোট আনেকগুলো পতাকা আর এক হাতে লম্বা বাঁশের মধ্যে ছোটবড় নানা আকৃতির পতাকা সাজিয়ে হেঁটে চলেন ধীর লয়ে। বেশিরভাগ সময় থামেন স্কুল ও কলেজের সামনে। স্কুল কলেজের ছেলেমেয়েরা সুযোগ বুঝে ছুঠে আসে তর কাছে।  উদ্দেশ্য একটাই- পতাকা কেনা। মকবুলের ভা-ারে থাকে ৫ টাকা থেকে শুরু করে রয়েছে ২৫০ টাকা দামের পতাকাও। টাকার অংক বুঝে দরদাম করে ছেলেমেয়েরা কিনে নেয় লাল-সবুজের পতাকা। কেউ পড়ার টেবিলে, কেউ ঘরের দেয়ালে আর কেউ ছাঁদে উড়িয়ে দেয় পতাকা। আবার কেউ কেউ মকবুলের ব্যাগে রাখা কাপড়ের ওপর মুদ্রিত রঙিন পতাকাসম্বলিত রিস্টব্যান্ডও কিনে নেয়। বিজয় দিবস আসার আগে রঙিন পতাকাসম্বলিত রিস্টব্যান্ড হাতে লাগিয়ে ঘুড়ে বেড়াতে তাদের বেশ লাগে!
এসব ক্রেতাদের নিয়েই চলে মকবুলের সারাদিনের কারবার। দিন শেষে লাল-সবুজের পতাকা বেঁচে আয় হয় ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। পেশায় রিক্সাচালক মকবুলের প্রতিদিনের নিয়মিত আয় এর চেয়ে আরো বেশি। তারপরও তিনি খুব খুশি। দেশের স্বাধীনতা আর পতাকার রঙ তাকে খুব টানে। তাই ডিসম্বের এলে আর স্থির থাকতে পারেন না। ছুটে আসেন জাতীয় পতাকার কাছে, স্বাধীনতা আর মর্যাদার প্রতীক পতাকাকে সাথে নিয়ে ঘুরে বেড়ান আর মনে মনে শ্রদ্ধা জানান স্বাধীনতার বীর যোদ্ধাদের।
মকবুলের মতো এমন দেশপ্রেমিকের সংখ্যা একবারে কম নয়। শুধুমাত্র ঢাকাতেই রয়েছে শতাধিক। ডিসেম্বরে জাতীয় পতাকা বিক্রি তাদের কারো কারো পেশা হলেও অনেকে জাতীয় পাতাকার প্রতি এক অজানা টান আর শখের বশে বিক্রি করেন জাতীয় পতাকা। আর তাদের বিক্রিত পতাকাতেই মূলত বিজয় দিবসে সারাদেশ সজ্জিত হয় অপরুপ সাজে।
আমাদের পতাকা ও তার রঙ লাল-সবুজ কিভাবে এলো? ইতিহাস ঘেঁটে যতটা জানা যায়- সরকারিভাবে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা সর্বপ্রথম ব্যবহার শুরু হয় স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১৭ জানুয়ারি। নক্সা ও রং হিসেবে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ব্যবহৃত পতাকাটির  রং ও নক্সাটি প্রায় হুবহু অনুসরণ করা হয়। তবে সে সময় লাল বৃত্ত ও সবুজ জমিনের সঙ্গে বাংলাদেশের মানচিত্রও ব্যবহার করা হয়েছিল। পরবর্তীতে নানাদিক বিবেচনা করে পতাকা থেকে বাংলাদেশের মানচিত্রটি বাদ দেওয়া হয়।
পতাকায় ব্যবহৃত রঙ লাল সবুজের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে- জমিনের গাঢ় সবুজ রঙ, সমগ্র বাংলাদেশের বুকজুড়ে বিস্তৃত ফসলের মাঠ এবং লাল বৃত্ত, একই সাথে বাংলাদেশের বুকে উদীয়মান সূর্য্য ও স্বাধীনতা সংগ্রামে যারা আত্মদান করেছেন তাদের পবিত্র তাজা লাল রক্তের প্রতীক।
পতাকার সর্বপ্রথম নক্সাবিদ হিসেবে আমাদের মধ্যে অনেকেই শিল্পী পটুয়া কামরুল হাসানের নাম জানলেও মূলত তিনি জাতীয় পতাকার নক্সাবিদ নন। স্বাধীনতার পূর্বে সর্বপ্রথম পতাকাটির ডিজাইন করেন একজন ছাত্র। ‘স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস’ সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ওই ছাত্রের নাম শিব নারায়ণ দাস।
আবাক হলেও সত্যি যে, সে সময় ‘স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস’ সংগঠনের ছাত্র নের্তৃবৃন্দের উদ্যোগে ঢাকার নিউ মার্কেটে অবস্থিত অ্যাপোলো টেইলার্সের মালিক বজলুর রহমান লস্করের কাছ থেকে পাওয়া কাপড় দিয়েই তৈরি হয়েছিল বাংলাদেশের সর্বপ্রথম পতাকা।
১৯৭১ সনের ২ মার্চ সে পতাকাটি সর্বপ্রথম উত্তোলন করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য ছাত্র নের্তৃবৃন্দের উপস্থিতিতে সর্বপ্রথম বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন তৎকালীন ডাকসু সহ-সভাপতি এএসএম আব্দুর রব।
এরপর ১৯৭১ সনের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ধানমন্ডির বাসভবনে সর্বপ্রথম পতাকা উত্তোলন করেন।
তবে জাতীয় পতাকার রঙ, আকার ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে বেশ কিছু বিধি নিষেধ রয়েছে। এসব নিয়ম মেনে জাতীয় পতাকা ব্যবহার করা প্রত্যেক নাগরিকের দায়িত্ব। তারপরও নানা সময়, নানা বেসরকারি অনুষ্ঠানে (এমনকি সরকারি অনুষ্টানেও এবং কখনো ব্যক্তিগতভাবে কোথাও কোথাও জাতীয় পতাকার যথেচ্ছ ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। অনেকে আমাদের স্বাধীনতা ও জাতীয় পরিচয়ের প্রতীক, জাতীয় পতাকার প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শন করতেও দ্বিধা প্রকাশ করেন। অনেকে আবার অতি উৎসাহী হয়ে যখন তখন, যেখানে সেখানে জাতীয় পতাকা উড়িয়ে দেন, যা একবারেই ঠিক নয়।
এর বিপরীতে, স্বাধীনতার এত বছর পরেও জাতীয় পতাকাকে এদেশেরই কোনও কোনও মহল বা কেউ কেউ এখনও একটুকরো রঙিন কাপড় বলে ঠাওরান। তাদের মত অকৃতজ্ঞ চতুষ্পদী স্বভাবের দু’পেয়েদের জন্যই বাঙাল কবি লিখেছেন- যেসবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/ সেসবে কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি (আব্দুল হাকিম, বঙ্গবাণী)।
যারা এদেশে বসবাস করে, এদেশের মাটি, আলো বাতাসে বেঁচে থেকে এখনও পাকি মগজে তেল দিচ্ছেন, তাদের বলছি- এই একটুকরো রঙিণ কাপড়কে অর্জণের জন্যই নিস্পাপ শিশু, নারী, বৃদ্ধসহ অগণিত মুক্তিযোদ্ধার অমূল্য জীবন উৎসর্গ করতে হয়েছে। এই একটুকরো কাপড়, আমার পতাকা, আমাদের কোটি মানুষের মাথা ঊঁচু করে বেঁচে থাকার প্রতীক, আমাদের জাতীয় পতাকা। সুতরাং এদেশে বাস করতে হলে, এদেশের আলো বাতাসে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে চাইলে, এই একটুকরো কাপড় লাল-সবুজের পতাকা তলেই মাথা নত করে থাকতে হবে। একেই শ্রদ্ধায়, সম্মানে সবার উপরে তুলে রাখতে হবে। অন্যথায়, আপনাদের ভালোবাসার পতাকা তলে চলে যান, এদেশে আর এক মূহুর্ত নয়!
কারণ-
‘আমাদের পতাকা আমাদের মান
সত্য, সুন্দর, বিজয় নিশান’

বাংলাদেশ সময়: ১২৫৭ ঘণ্টা, ১৫ ডিসেম্বর, ২০১১
















বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

খগেন বাবু

খগেন বাবু


আসাদুল হক খোকন
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
টাকু মাথার খগেন বাবু
চিনেন সবাই এক নামে,
বাড়িটি তার পুকুর পাড়ে
তাল গাছটি- তার বামে।

খগেন বাবু, মধ্য পাড়ার
তা-ও চেননি বুঝি?
অরুণ কাকার কানাই দাদু-
তার সে ছেলে- খগেন চ্যাটার্জি!

খগেন বাবু যেন তেন নন
সবাই তারে ডরান,
সামনে পেলে যে কোন লোক
তাকেই ধরে পড়ান।

কোন কথাটির কি মানে আর
কোন কথাটি দরকারী,
কোন দেশে হয় পেস্তা- আপেল
কোথায় ফলে তরকারী।

ভূ-গোল, গুগোল, হিস্ট্রি আর
কিংবা জটিল অংক হোক,
সব বিষয়ে টনটনে জ্ঞান
খগেন বাবু এমন লোক!

কেমন করে ড্রোন উড়ে যায়
কি করে হয় ঘুর্ণিঝড়,
বাংলানিউজ পড়েই জানেন
সারা বিশ্বের সব খবর!

সর্বজ্ঞানী খগেন বাবু
সবার প্রিয় খগেন দা,
বিনামূল্যে জ্ঞান বিলালেন
পেলেন না ঠিক মর্যাদা!
















বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

ডোরেমন

ডোরেমন


আসাদুল হক খোকন
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
কার্টুন প্রায় সব শিশুর কাছেই প্রিয়। আমি নিজেও কোনো কোনো কার্টুনের ভক্ত। যেমন- টম অ্যান্ড জেরি!

একটা সময় ‘টম অ্যান্ড জেরি’ ছিল শিশুদের বিশ্বের বিভিন্ন দেশসহ বাংলাদেশের শিশুদের কাছেও ফেভারিট কার্টুন। আর এখন ডোরেমন। তার মানে, কার্টুন জগতে এখন ডোরেমনের চেয়ে বেশি জনপ্রিয় সিরিয়াল খুব কমই আছে।

চলো এবার তোমাদের  মনোজগতের মডেল কল্প-চরিত্র ডোরেমন সম্পর্কে বেশ কিছু মজার তথ্য জেনে নেয়া যাক।

আচ্ছা, ডোরেমন দেখতে দেখতে কি তোমাদের মনে কখনো এই প্রশ্ন জাগেনি, এই ডোরেমন কার্টুনের স্রষ্টা কে? কবে? কিভাবে? এমন সুন্দর এই কার্টুনের জন্ম হলো?

নিশ্চয় জেগেছিলো। কিন্তু কেউ হয়তো তোমাদের এই মূল্যবান তথ্যগুলো জানায়নি।

আসলে, হিরোশি ফুজিমোতো এবং মোতো আবিকো নামের জাপানী ২ জন কার্টুনিস্টের মেধা ও কল্পনার ফসল এই ডোরেমন।

১৯৫৪ সালে তারা দু’জনে ‘ফুজিকো ফুজিয়ো’ নামে জুটি বাঁধেন। আর দু’জন মিলে একসঙ্গে আঁকাআঁকি করেন ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত। অর্থাৎ কার্টুন আঁকার জন্য দু’জন মিলে একটা ছোট্ট দল গঠন করেন এবং এর নাম দেন ‘ফুজিকো ফুজিয়ো’।

তোমাদের প্রিয় কার্টুন ডোরেমন যে এ দু’জন কার্টুনিস্টের হাতেই জন্মেছিলো সেটি  নিশ্চিত করে বলা যায়। কিন্তু কবে জন্মেছিলো, এমন প্রশ্নের উত্তর ফুজিকো ফুজিয়ো কখনোই বলেননি।

তবে প্রথম ডোরেমন কার্টুনটি বের হয় ১৯৬৯ সালের ডিসেম্বরে, এক সাথে জাপানের ছয়টি ম্যাগাজিনে!

এক সাথে ছয়টি ম্যাগাজিনে কেন?

কারণ, জাপানে আলাদা আলাদা ক্লাসের শিশুদের জন্য বের হয় সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন ম্যাগাজিন। এরকম ছয়টি ক্লাসের ম্যাগাজিনে একসঙ্গে ছাপা শুরু হয় ডোরেমন।

ডোরেমনের জনকরা এক সময় আলাদা হয়ে যান। তারপরও কিন্তু তাঁরা কার্টুন আঁকাআঁকি ছেড়ে দেননি। আবিকো এখনো ফুজিকো ফুজিয়ো নামেই আঁকেন। আর ফুজিমোতো আঁকতেন ফুজিকো এফ ফুজিয়ো নামে। আঁকতেন বলছি এজন্য যে, ১৯৬৯ সালে ফুজিমোতো মারা গেছেন।

ডোরেমন সম্পর্কে তোমাদের একটা মজার তথ্য দেই। ডোরেমন নামটার শেষের অংশটা, মানে ‘ইমন’ কিন্তু জাপানের ছেলেদের একটা জনপ্রিয় নাম। আগে অনেকেই তাদের ছেলেদের নামের শেষে ইমন লাগিয়ে নিতো। ধরো কেউ হয়তো তাদের ছেলের নাম রাখলো জো। তার শেষে ইমন লাগিয়ে সেটাকে করে ফেললো- জোয়েমন।

আচ্ছা, তোমরা কি জানো ডোরেমন মানে কী? ডোরা মানে হলো এমন ব্যক্তি, যে অন্যদের ভালো পথে চালায়। ডোরেমন তো নবিতাকে সবসময় ভালো পথে চলতেই শেখায়। যাতে সে ভালো কাজ করে আর ঠিকমতো পড়াশোনা করে।

কিন্তু বলে যে রাখা ভালো যে, ডোরেমন আসলে একটা রোবট বিড়াল! ভবিষ্যৎ থেকে আসা এক রোবট!

আর একটা তথ্য ডোরেমন যে পকেট থেকে ও একটার পর একটা গ্যাজেট বের করে, সেই পকেটটা আসলে একটা ফোর ডাইমেনশনাল পকেট। মানে ফোর-ডি পকেট আরকি! জাপানি ভাষায় ওরা বলে ‘ইয়োজিন পকেট’। ওখান থেকে ও আসলে ভবিষ্যতের নানা টুলস বের করে। আর ভবিষ্যতের ওই টুলসগুলোকেই আমরা বলি গ্যাজেট।

ডোরেমন মূলত এসেছে নবিতার জন্যই। নবিতার কোনো কাজে মনোযোগ নেই, শুধু খেলা আর খেলা। আর সব জায়গায় শর্টকাট  খোঁজে। কিভাবে তাড়াতাড়ি হোমওয়ার্ক করা যায়, কিভাবে তাড়াতাড়ি বাজার করে আনা যায়, খালি এসব দুষ্টু চিন্তা। কিন্তু জীবনে উন্নতির জন্য কি আর এমন কোনো শর্টকাট আছে?

তার উপর ও খুব ভীতু।  বড় হয়ে ও হলো যেমন গরীব, তেমনি অভাগা। আর ওর বংশধরদেরও অবস্থাও হলো তেমনই।

তখন ওর নাতির যে নাতি, তার নাতি সিওয়াসি ভবিষ্যৎ থেকে ওর কাছে পাঠালো ডোরেমনকে। যাতে নবিতা, ডোরেমনের কাছ থেকে জীবনে উন্নতি করার যতো রকম শিক্ষা দরকার, সে সব পেয়ে জীবনে উন্নতি করতে পারে। আর তাহলেই তো ওর বংশধররাও বেশ উন্নতি করতে পারবে। তখন আর তাদের এ গরীব হালও থাকবে না, এতো কষ্টও থাকবে না।

এসব  কারণেই ডোরেমনের সৃষ্টি!
















বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

ভ্যালেন্টাইন ডে : প্রথা, মিথ ও কুসংস্কার

ভ্যালেন্টাইন ডে : প্রথা, মিথ ও কুসংস্কার


আসাদুল হক খোকন
সত্যিকার ভ্যালেন্টাইন’স ডের ইতিহাস সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞের ধারণা রোমান সেন্ট ভ্যালেন্টাইন খ্রিস্টধর্ম ত্যাগ না করায় তাকে নির্মমভাবে হত্যার ঘটনা থেকেই এর উৎপত্তি। ২৬৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি তার আত্মত্যাগের ওই দিনটি ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে পালিত হয়।

কিছু বিশেষজ্ঞ অবশ্য বলে থাকেন, সেন্ট ভ্যালেন্টাইন কারাগারে বন্দি থাকার সময় কারারীর মেয়েকে তার স্বারিত একটি চিঠি  দেন, যাতে লেখা ছিল  ‘লাভ ফ্রম ইওর ভ্যালেন্টাইন’। ভালোবাসার এমন স্মৃতিকে জড়িয়েই পরবর্তী সময়ে ভ্যালেন্টাইন ডে’র প্রচলন হয়।

অপর একটি ধারণা, রোমান সম্রাট কডিয়াসের সময় সেন্ট ভ্যালেন্টাইন গির্জার ধর্মযাজক ছিলেন। কডিয়াস তার সাথে মতবিরোধের জন্য প্রথমে তাকে কারাবন্দি করেন। পরে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেন।

৪৯৬ খ্রিস্টাব্দে পোপ জেলাসিয়াস সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের সম্মানে ১৪ ফেব্রুয়ারি দিনটি নির্ধারিত করেন এবং পরবর্তীকালে তার নামানুসারেই পালিত হতে থাকে এই অনুষ্ঠান।

ভ্যালেন্টাইন’স ডে উদযাপন শুরু হয় রোমান সাম্রাজ্যের সময় থেকে। প্রাচীন রোমে ১৪ ফেব্রুয়ারি ছিল রোমান দেবদেবীদের রানী জুনোর  সম্মানে পবিত্র দিন। রোমানরা তাকে নারী ও বিবাহের দেবী বলে বিশ্বাস করত। দিনটি অনুসরণ করে পরের  দিন ১৫ ফেব্রুয়ারি পালিত হতো লুপারকেলিয়া উৎসবের বিশেষ ভোজ।

সে সময় তরুণ এবং তরুণীদের জীবনযাপন ব্যবস্থা ছিল সম্পূর্ণ পৃথক। কিন্তু তরুণদের জন্য ‘দৃষ্টি আকর্ষণ’ নামে একটি ভিন্নধর্মী প্রথা ছিল ‘লটারি’। লুপারকেলিয়া উৎসবের সন্ধ্যায়  কাগজের টুকরায় তরুণীদের নাম লিখে একটি পাত্রে জমা করা হত। সেখান থেকে এক একজন তরুণ একটি করে কাগজের টুকরা তুলত এবং কাগজের টুকরায় যে তরুণীর নাম লেখা থাকত ওই উৎসবের সময় পর্যন্ত সে তাকে তার সঙ্গী হিসেবে পেত। পরে কখনো কখনো ওই দুজনের জুটি পুরো বছর ধরে টিকে থাকত এবং প্রায়শ তারা একে অপরের প্রেমে পড়ত এবং সব শেষে তা বিয়ে পর্যন্ত গড়াত।

সম্রাট কডিয়াসের শাসনামলে রোম কয়েকটি জনবিরোধী এবং রক্তয়ী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। হিংস্র প্রকৃতির কডিয়াস সে সময় তার সেনাবাহিনীতে যথেষ্ট সংখ্যক সৈন্য ভর্তি না হওয়া নিয়ে খুব কঠিন সময় পার করছিলেন। রোমান পুরুষদের তাদের পরিবার ও ভালোবাসা ত্যাগ করে যুদ্ধে না  যাওয়াকেই এর প্রধান কারণ হিসেবে দায়ী করছিলেন তিনি। ফলে কডিয়াস সমগ্র রোমে সব ধরনের বিয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। সে সময় সেন্ট ভ্যালেন্টাইন রোমের একজন ধর্মযাজক ছিলেন।  তিনি এবং সেন্ট ম্যারিয়াস খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী তরুণ-তরুণীদের গোপনে বিয়ে দিতেন এবং বিবাহিত যুগলদের সহযোগিতা দিতেন। এ কারণে রোমের ম্যাজিস্ট্রেট তাকে গ্রেফতার করে কারাবন্দি করেন।

ভ্যালেন্টাইন বন্দি থাকা অবস্থায় অনেক তরুণ তাকে দেখতে যেত এবং কারাকরে জানালা দিয়ে তার উদ্দেশ্যে লেখা চিরকুট ও ফুল দিয়ে তাদের ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করত। হাত নেড়ে তাকে জানাত যে, তারা ‘যুদ্ধ নয়, ভালোবাসায় বিশ্বাসী’। এদের মধ্যে একজন ছিল কারারীর মেয়ে। তার বাবা তাকে ভ্যালেন্টাইনের সাথে সাক্ষাৎ করতে এবং তার সাথে কথা বলতে সুযোগ করে দিত। মেয়েটি তাকে তার প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, কডিয়াসের নির্দেশ অমান্য করে তরুণ-তরুণীদের গোপনে বিয়ে দেওয়া এবং  ভালোবাসায় তার সমর্থনের কথা জানায়। এক সময় তারা এক অপরের বন্ধু হয়ে যায়। ভ্যালেন্টাইনের শিরোচ্ছেদ করে হত্যার দিনে তিনি মেয়েটিকে তার বন্ধুত্ব এবং ভালোবাসার প্রতি বিশ্বাস নিয়ে একটি চিরকুট লিখে রেখে যান। এতে তিনি লিখেছিলেনম, ‘লাভ ফ্রম ইওর ভ্যালেন্টাইন’। বিচারকের নির্দেশ অনুসারে সে দিনই তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের এই আত্মত্যাগের দিনটি ছিল ২৬৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি।

সত্যিকার অর্থেই প্রাচীন রোম ছিল নানা প্রথা ও কুসংস্কারের অন্ধকারে নিমজ্জিত একটি দেশ। এসব প্রথার মধ্যে লুপারকেলিয়া ছিল একটি। এটি অনুষ্ঠিত হত ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখ। ৪৯৬ খ্রিস্টাব্দে পোপ জেলাসিয়াস সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের সম্মানে লুপারকেলিয়া অনুষ্ঠানের দিন ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখের পরিবর্তে ১৪ ফেব্রুয়ারি  নির্ধারিত করেন।  পরে এটি সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের নামানুসারে ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ নামে দ্রুত পরিচিতি লাভ করে।

কালের ধারাবাহিকতায় ১৪ ফেব্রুয়ারি প্রেমিক-প্রেমিকাদের কাছে ভ্যালেন্টাইন ডে এবং সেন্ট ভ্যালেন্টাইন এর কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। নানা সামাজিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি বাহারি ফুল, কবিতা ও ছোটখাট উপহার বিনিময়ের মধ্য দিয়ে সারা বিশ্বে দিনটি ব্যপকভাবে উদ্যাপিত হয়।

আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মিস্ এস্থার হাওল্যান্ড প্রথম ভালেন্টাইন কার্ড  পাঠানোর প্রচলন করেন। ১৮০০ সাল থেকে দিনটি বাণিজ্যিকভাবে উদ্যাপন শুরু হলেও বর্তমানে এটি বিশ্বের অনেক দেশেই বাণিজ্যিকভাবে উদ্যাপিত হয়। বিশেষ করে ১৪ ফেব্র“য়ারিকে ঘিরে লাভল্যান্ড ও কলারাডো সবচে বেশি ব্যবসায়িকভাবে  লাভবান হয়।

আজ থেকে শতবর্ষ আগে ব্রিটেনে ছোট শিশুরা দল বেঁধে বাড়ি বাড়ি গান গেয়ে দিনটি উদ্যাপন করত। ওয়েলেসে কাঠের তৈরি চামচের ওপর হৃৎপি-, তালা, শেকল প্রভৃতির নকশা খোদাই করে এ দিনে উপহার দেয়া হতো। এর মানে ছিল ‘ইউ আনলক মাই হার্ট’। কোথাও আবার এ দিনে তরুণীরা রোদে একটি বাটিতে পরিষ্কার পানি রেখে তার ওপর চেয়ে থাকত। ধারণা করা হতো, যার ছবি ওই পানিতে ভেসে উঠবে সে-ই হবে তার কাক্সিক্ষত ভ্যালেন্টাইন। কোথাও ফেব্র“য়ারির ১৪ তারিখে তরুণ-তরুণীরা  তাদের জামার হাতায় কাক্সিক্ষত ভালোবাসার মানুষটির নাম লিখে সপ্তাহজুড়ে ঘুরে বেড়াত। তারা ধরেই নিতো, এর ফলে সহজেই কাছে পাবে তার ভালোবাসার মানুষটিকে।

কোনো কোনো দেশে ১৪ ফেব্রুয়ারিতে অবিবাহিত ছেলেরা মেয়েদের নতুন পোশাক উপহার হিসেবে পাঠাত এবং মেয়েটি ওই পোশাক গ্রহণ করলে ধরে নেয়া হতো, মেয়েটি তাকে বিয়ে করতে রাজি আছে। ওইসব দেশে কিছু লোকদের ভ্যালেন্টাইনের ওপর বিশ্বাস আরো একধাপ এগিয়ে।  তারা বিশ্বাস করত, ১৪ ফেব্রুয়ারিতে যদি কোনো মেয়ে তার মাথার ওপর একটি ফিতা উড়ে যেতে দেখে তাহলে তার বিয়ে হবে কোনো নাবিকের সাথে, যদি সে একটি চড়ুই পাখি দেখে তবে তার বিয়ে হবে একজন দরিদ্র লোকের সাথে, কিন্তু সে হবে খুবই সুখী। আর যদি সে সোনালি রঙের মাছ দেখে তবে তার বিয়ে হবে একজন প্রভাবশালী ধনাঢ্য লোকের সাথে।

পৃথিবীর অনেক দেশেই এমন সব হাজারো প্রথা, কুসংস্কার ও  মিথ জড়িয়ে আছে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের আত্মত্যাগের কাহিনীকে ঘিরে। ভালোবাসা সব সময়ই সর্বজনীন। আর ভালোবাসার জন্য শুধু ভ্যালেন্টাইন কেন, যুগে যুগে পৃথিবীর বহু দেশে অসংখ্য মানুষ অকাতরে জীবন দিয়েছেন। কিন্তু ঘটা করে বছরে একবার নারী-পুরুষের ভালোবাসা প্রকাশের জন্য শুধু ভ্যালেন্টাইন নামক অনুষ্ঠানকে বেছে নেওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত, এ প্রশ্ন থেকেই যায়।

পরিবর্তিত সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ভালোবাসার শরীরেও লেগেছে আধুনিক প্রযুক্তির স্পর্শ। ডাকঘর, চিঠি আর ডাকপিয়নের জন্য কারো প্রতীক্ষায় প্রহর গুনতে হয় না। মুঠোফোন, এসএমএস আর ইন্টারনেট মুহূর্তেই ভালোবাসার মানুষটিকে চোখের নাগালে নিয়ে আসতে সম। প্রযুক্তির কল্যাণে ভ্যালেনটাইন ডেও পেয়েছে এখন নতুন মাত্রা। জয় হোক ভালোবাসার।

বাংলাদেশ সময় ১৪১৫, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১১
















বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।








0digg
Bookmark and Share






ফিচার-এর সর্বশেষ ২৪ খবর












For showing Bangla
Find banglanews24.com at FaceBook Find banglanews24.com at Twitter Find banglanews24.com at YouTube RSS Feed




Line

প্লেটোনিক প্রেম: সে কি নিকষিত হেম!

প্লেটোনিক প্রেম: সে কি নিকষিত হেম!


আসাদুল হক খোকন
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বিশ্বজুড়ে দর্শন শাস্ত্রবিদদের নামের তালিকায় গুরু সক্রেটিসের পাশাপাশি প্লেটোর (জন্ম ৪২৮ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ) নাম সমান দ্যুতিতে দেদীপ্যমান। ওই যুগের অপর মহীরূহ দার্শনিক অ্যারিস্টটলের গুরু প্লেটোর বহুল আলোচিত নানামুখী দর্শন ও মতবাদের মধ্যে ‘প্লেটোনিজম’ একটি। সময়ের পরম্পরায় দেহলেশহীন প্রেমের  সাথে এই দার্শনিকের নাম জড়িয়ে গেছে অঙ্গাঙ্গিভাবে।
পরবর্তীতে প্লেটোর মতবাদ ‘প্লেটোনিজম’ থেকেই প্রেমের একটি পর্যায়ের নামকরণ করা হয়েছে প্লেটোনিক লাভ বা প্লেটোনিক প্রেম। যে প্রেমে প্রেমিক-প্রেমিকা ভালোসার গভীরে অবগাহন করবে কিন্তু শরীর নামক বস্তুটির কোনও প্রকার উপস্থিতি থাকবে না- প্লেটোর মতবাদ অনুসারে  মুলতঃ প্লেটোনিক প্রেমের সজ্ঞা এমনটাই।
তার মানে কি এই যে, সুদূর অতীতে এই গ্রিক দার্শনিকই সর্বপ্রথম ভালোবাসার রাজ্য থেকে মুছে দিতে চেয়েছিলেন শরীরকে?
প্লেটোর দর্শনের একাংশে অবশ্যই শরীরবিহীন এক অদৃশ্য প্রেমের ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। কিন্তু সেই প্রেম ঠিক মোটাদাগের প্রেমের তত্ত্বস্থাপনা নয়! তাই বিষয়টি সাধারণ চোখে শুধুমাত্র প্রেম বা ভালোবাসা বলে ধরা হলেও এর অভ্যন্তর বেশ জটিল আর বাইরের দেয়ালও নানা আবরণে আচ্ছাদিত। অর্থাৎ  মন-মগজ আর শারীরিক প্রেমের পাশাপাশি যে প্রেমে শরীর বিষয়টি অনুপস্থিত অথচ প্রেমের স্বাদ বা রস আস্বাদন করা যায় ষোল আনা, প্লেটো ঠিক এমন এক প্রেমানুভূতিকে পৃথকভাবে যুক্তি দিয়ে উপস্থাপন করেছেন।
05
এটি আসলে ভালোবাসারই একটি মূল উপাদান বা অনুভূতির নাম যা কম বেশি সব প্রেমিক প্রেমিকাই তার প্রেমপর্বের কোনও একটা সময় এসে উপলব্ধি বা অনুভব করেন। তখন প্রেম তার কাছে ধরা দেয় দেহলেশহীনভাবে, তার মগজ ও মনে তখন সেই প্রেম এসে বাসা বাঁধে এক অদৃশ্য ইমেজ বা ছায়ারূপে। আর সেই ইমেজ এতটাই দৃঢ়ভাবে হৃদয়ে প্রথিত হয় যে শুধুমাত্র প্রেম নামক একবিন্দু অনুভুতিকেই স্বর্গ বলে ভাবতে শুরু করে প্রেমিকরা। তবে; প্রেমের এই আবহ সৃষ্টি হয় প্রেমের ডিসকভারি পিরিয়ড বা প্রাথমিক স্তরেই। মহামতি প্লেটোর দর্শনে ঠিক এমন আবহ সৃষ্টির সময় ও প্রেমানুভূতিকেই মূলতঃ অভিহিত করা হয়েছে ‘প্লেটোনিক প্রেম’ (বায়বীয় প্রেম!) হিসেবে।
প্লেটোনিক প্রেমের শুরু বা ডিসকভারি পিরিয়ডে এদেশের লাইলী-মজনুর কাহিনী কিংবা বিদেশের রোমিও-জুলিয়েট এমনকি একেবারে আমাদের মত মানুষের প্রেমেও একটা বিষয় কমন। তা হলো, শুরুতে আমাদের প্রেমের সাথে শরীরের যোগটা একেবারেই থাকে না।
সময়সীমার ভিন্নতা হলেও প্রেমের অন্যান্য উপাদানগুলো অবশ্য যথার্থ বিদ্যমান থাকে। তখন আমরা প্রেমিক-প্রেমিকাকে বুঝে ফেলার পাশাপাশি আবিষ্কার করি-সময় বড় বেশি দ্রুত ধাবমান, রক্তচোষা স্কুটারচালকেরাও কত মহান, ঝালমুড়ি-চটপটির মত আদর্শ খাবার আর নেই, কবিতাই হলো জীবনের শ্রেষ্ঠ আশ্রয়, কোন কোন গান শুনে মনে হয় নিজের জীবনের ঘটনাই যেন সুর হয়ে বাজছে, চারপাশের প্রকৃতি কত মনোরম এমন আরো কত কি।
বর্তমানে প্রেমের এসব উপাদান ও প্রক্রিয়াতে লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। এখনকার প্রেমিক-প্রেমিকারা তাই ভালোবাসার মানুষটির সাথে দেখা হবার পর ভাবতে শুরু করে- মোবাইল কল কেন ফ্রি হয় না, ইন্টারনেটে কেন সারাটা সময় তাকে পাওয়া যায় না, পহেলা বৈশাখ, বিজয় দিবস বা ভ্যালেন্টাইন ডে’র মত দিনগুলো কেন বারবার আসে না আর সর্বোপরি ‘সে হীন জীবন সত্যি মরুভূমি!’ অথচ, তার সাথে দেখা হওয়ার আগে এসব সম্পর্কে কী উল্টো ধারণাটাই না ছিলো!
প্রেমের এই সময়ে শরীর নয় মনই সব। নিজের মনটাকে অন্যের হৃদয়ের গভীরে তখন কেবল আমূল সেঁধিয়ে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা। এই ভালোবাসায় শরীর কোথায়? যদিও ফ্রয়েড বলেছেন- মানুষের মনে যৌন প্রকৃতির অনুপ্রবেশ ঘটে মাত্র ৩ থেকে ৫ বছর বয়সের মধ্যে। যদি তাই হয়, তাহলেও এই যৌনতার বহিঃপ্রকাশ তো সে সময় ঘটেই না বরং যৌন অনুভূতিও থাকে মনের অতলে ঘুমন্ত অবস্থায়। সুতরাং ফ্রয়েড সাহেবের যুক্তি এখানে খুবই নড়বড়ে! অচল!
প্লেটোর দর্শনের একাংশে এমন এক চিরন্তন সৌন্দর্যের কথা বলা হয়েছে যা ইন্দ্রিয়াতীত। ইন্দ্রিয়াতীত প্রেমের সাথে তার সংমিশ্র রূপই মানুষের চির সন্ধিৎসার বিষয়। কিন্তু এই ব্যাপক উচ্চ মানসিক প্রেম ও সৌন্দর্যকে বোঝার জন্যই মানুষকে লৌকিক প্রেমের সরোবরে অবগাহন করতে হয়। আর তখনই তার ভেতরে জেগে উঠতে থাকে পারমার্থিক আকাশে উড়ার ভাবনা। অর্থাৎ মহত্তর ‘আমি’ ক্রমে তার কাছে প্রতীয়মান হয়, যেন মর্ত্য মানবীর তুলনায় পরা প্রকৃতির রূপশ্বৈর্য কত বেশি! তখন ইন্দ্রিয়ের ছোট গ-ি পেরিয়ে, সমস্ত ক্লেদ ঝেড়ে ফেলে তার জীবনে আসে নতুন দিগন্ত। নতুনের পথে তার যাত্রা হয় শুরু। বোঝা কঠিন নয়, এই ভাবনাই কাজ করেছে নিষ্কাম প্রেম সম্পর্কিত ধারনার প্রথম পাঠ হিসেবে।
06
 রবীন্দ্র ভাবনায় পাওয়া  গেছে এর পরিষ্কার প্রস্ফুটন-
‘লোভের অতীত যাহা
সুন্দর যা অনির্বচনীয়
যাহা প্রিয়।’
অর্থাৎ ভালোবাসা আর সুন্দর একই বিন্দুতে মিলিত হয়েছে। কিন্ত; সেখানে কোনও লোভের ছোঁয়া নেই। আছে অনির্বচনীয়তা। এখানে লোভ মানে অবশ্য গ্রিড নয় ‘ইরোটিসিজম’। তবু একথা বলা যাবে না যে ধারণাটি নিছকই ধার করা বা বিদেশি। এর শেকড় আমূল প্রথিত রয়েছে এদেশের মাটিতেও। প্লেটোর অতীন্দ্রিয় প্রেমতত্ত্ব রবীন্দ্র ভাবনায় যদি বীজ হিসেবে কাজ করে থাকে তবে এক্ষেত্রে উর্বরতা বৃদ্ধিতে কাজ করেছে প্রাচ্য দর্শন আর বৈষ্ণব প্রেম তত্ত্ব।
কবিগুরুর পর এবার প্লেটোনিক প্রেমের আর এক অমর দৃষ্টান্ত চণ্ডীদাসের কাছ থেকে চলুন ঘরে আসা যাক। চ-ীদাসের সাথে রজকিনীর প্রেমের কথা সকলেরই জানা। সমাজ তাদের প্রেমকে রক্তচক্ষু দেখিয়ে উৎপীড়ন করেছিল। অত্যাচারও কম করেনি! কেউ কেউ বলেন- সামাজিক ও বিত্তবৈভবের অসমতাই ছিল তাদের প্রেমের পথে প্রধান অন্তরায়। আর তাই তাদের প্রেমের ফল পরিণতির দিকে না গিয়ে বিচ্ছেদ-বিরহে রূপ নিয়েছে। তাদের ভাষায় এক প্রকার ব্যর্থ প্রেমের নায়ক চণ্ডীদাস।
তবে; সারকথা হলো, বৈষ্ণব পদকার বা কবি চণ্ডীদাসকে রজকিনীর সাথে তার দীর্ঘ্য বিরহী প্রেম কাহিনীকে উপলক্ষ্য করে নিন্দুকেরা যতই তামাশা করুক না কেন, চণ্ডীদাস কিন্তুকবিতায় ঠিকই তার প্রেমের ধরনটি আমাদের স্পষ্ট  করেছেন -
‘রজকিনী প্রেম নিকষিত হেম
কাম-গন্ধ নাহি তায়!’
ব্যক্তিগত জীবনে এমন ব্যথা-সুরভীত প্রেমের অভিজ্ঞতা ছিল বলেই বুঝি চণ্ডীদাসের প্রতি পদে, প্রতি ছত্রে প্রবাহিত হয়েছে রাধার নিষ্পাপ প্রেমের অশ্রুধারা!
অন্যদিকে পদাবলীর পদ যাকে নিয়ে রচিত হয়েছে, সেই কৃষ্ণের তুলনায় চণ্ডীদাসও অনেক অর্বাচীন। তাই প্লেটোর সাথে সময়ের বাজীতে নিঃসন্দেহে জিতে যাবেন কৃঞ্চ। মূলত: প্রেমের তিনি ঠাকুর! প্রেমের তিনি রাজা!
ভালোবাসা চিরকালই চিরহরিৎ বনের মত, নৈসর্গিক সবুজে আবৃত এক সোনার হরিণ। সবার জীবনে তার দেখা মেলে না। আবার কারো কারো মিললেও ধরা দেয় না। বাকি জীবনে তাই অধরাকে ধরার বাসনা সুপ্তই থাকে।

আর যে ভালোবাসা কামগন্ধহীন, কেবলই নিজেকে বিলিয়ে দেয় পরিবর্তে নেয় না কিছুই? সেতো দুষ্প্রাপ্য নাইট কুইন অথবা আমাজান লিলির মত একই সাথে মনোলোভা এবং ক্ষণস্থায়ী! এমন নিষ্কাম প্রেম, যে প্রেম রাজাধিরাজের মত দু’হাত ভরে শুধু দিয়ে যায়, নেয় না কিছুই। যাকে লাভ করার জন্যে দীর্ঘ্য প্রতীক্ষা আর দুঃসহ যন্ত্রণাসমূহও সহ্য করতে হয় মুখ বুজে। বিনিময়ে কখনো কখনো কপালে জোটে ব্যর্থ প্রেমিকের অপবাদ ছাপ! প্রেমের জন্য স্বেচ্ছায়-স্বজ্ঞানে নিজের জীবনকে অন্ধকারে ঠেলে দেয়- প্রেমের এমন ভয়ঙ্কর রূপের নামই তো প্লেটোনিক লাভ!

একটু ভিন্ন অভিধা ও মোড়কে জড়িয়ে আমাদের কাছে যে এক বিস্ময়কর, আশ্চর্য ভালোলাগার অনূভূতি মিশ্রিত শিরি-ফরহাদ ও লাইলী-মজনুর কালজয়ী প্রেম কাহিনী পরিবেশিত হয়েছে মূলতঃ প্লেটোর দর্শিত সে প্রেমও কী শুধুই দেহলেশহীন অস্পৃশ্য এক গভীর আবেগের নাম নয়? যাকে আমরা প্রেম বলে বিবেচনা করেছি? প্লেটোনিক নামটি এখানে ভিন্ন ছাঁচে একই উপাদানে নির্মিত একটি ‘ব্র্যান্ড নেম’ ছাড়া কিছু নয়।
04
প্রিয়া বিরহে মজনু যখন দিওয়ানা বা পাগলপারা তখন তিনি পথে লাইলীর পালিত কুকুরকে পেলে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে থাকতেন। লোকে তার পাগলামি নিয়ে প্রশ্ন করলে সে জবাব দিতো- ‘আমি জানি এটি লাইলীর কুকুর। আমার প্রেমিকা লাইলী একে খেতে দেয়, কুকুরটি তার আশে পাশেই ঘুরঘুর করে আর লেজ নাড়িয়ে তার প্রভুর কাজে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। এসময় কখনো হয়তো বা কুকুরটির গায়ে লাইলীর শরীরের কোমল স্পর্শ লেগে থাকবে। তাই কুকুরটিকে চুমু খাওয়া!’

ইরানের একটি গজলের কথা এরকম-

‘কাজু বাদামের ফালির মত চাঁদের ম্লান আলোর টুকরো
জানালা দিয়ে আমার বিছানায় এসে পড়ে যখন
দূরে চিনারের বনে অসময়ে ঝড়ো হাওয়া
মাতাল হয়ে ওঠে যখন-
তখন তোমাকে খুব মনে পড়ে আমার
অথচ তোমার নাম আমার মুখে আনাও মানা!’
 
ইরানী এই গজলটিতে প্রেমেপড়া মেয়েটির যে তীব্র অথচ অশালীন নয় এমন আবেগের কথা শোনা যাচ্ছে, ঠিক তার মত দেহাতীত প্রেমের আবেগ জড়ানো ভাবনা আমাদের ছেলেবেলার অনেকটা সময়জুড়ে লেপটে থাকলেও এমন প্রেমকে নিজের জীবনে ভাবার সময় হয় না অনেকেরই। নাগরিক ব্যস্ততা ও আটপৌরে প্রাত্যহিকতায় ডুবতে ডুবতে অর্থ, লোভ ও প্রতিপত্তির কথা ভাবতে ভাবতে একসময় অনেক দূরে সরে যেতে হয় এই স্নিগ্ধ প্রেমের আবহ থেকে জাগতিক স্বার্থপরতার দিকে। তবু এ উপলব্ধি কম-বেশি আমাদের জীবনের পরতে পরতে জমে থাকা স্মৃতিগুলির মধ্যে যে সবচেয়ে ‘সুখের স্মৃতি’ হয়েই ধরা দেয়, একথা অস্বীকার করার উপায় নেই।

যাকে ভালোবাসা যায় তার উপস্থিতিই তো যথেষ্ট। একজন অন্যজনকে ভালোবাসবে প্রচণ্ড স্বার্থপরের মত, ভালোবাসার মানুষটির জন্য অব্যক্ত ‘মন কেমন করা’ অনুভূতি যেন ঘিরে থাকে প্রতিটি মুহূর্ত। দ্রোহ ও প্রেমের কবি আমদের নজরুলের গানে যেন ঠিক এমন মুহূর্তটিই ধরা পড়ে-

‘উচাটন মন ঘরে রয় না
প্রিয়া মোর ...’

কখনো কখনো এমন মন উচাটন হলে প্রিয় মানুষটিকে কাছে পাবার বাসনা ক্রমশ তীব্র থেকে তীব্রতর হবে। তখন ভালোবাসার মানুষটিকে মন কাছে পেতে চাইবে একান্ত আপন করে কিন্তু তারপরও বিবাহবন্ধন দ্বারা পরিপক্ক বাঁধন তৈরি করবে না। পৃথিবীর আর দশটি মানুষের মত প্রিয়ার শরীরের বাঁক-ভাজ, চড়াই-উৎরাই  প্রিয় কবিতার প্রতি পঙক্তির মত মুখস্ত থাকবে না । তবেই তাকে বলা যাবে  প্লেটোনিক প্রেম।

মোটকথা প্লেটোনিক প্রেম তা-ই, যা পরস্পরের প্রতি কখনোই আরোপ করবে না অধিকারবোধ, আশা করবে না প্রতিদান অথচ ভালোবাসার উত্তেজনা থাকবে টানটান। সে টানের তীব্রতায় কখনো কখনো প্রেমিক প্রেমিকাকে জাগতিক দায়িত্ববোধশুন্য এক অদৃশ্য জগতের বাসিন্দা হতেও দেখা যায়।

উদাহরণ টানতে আবারও প্রেম আর দ্রোহের কবি নজরুলের কাছে যেতে হয়। কবি তার প্রেম কতটা নিঃস্বার্থ এবং তার অনুভুতি কতটা পারমার্থিক তা বোঝাতে গাইলেন আরো একধাপ এগিয়ে-

‘আমি চিরতরে দূরে চলে যাব
তবু আমারে দেবো না ভুলিতে’

আসলে ভালোবাসায় যার হৃদয় সরোবর পরিপূর্ণ তার আর কী চাই? গ্যাটে তার কবিতায় ছড়িয়ে দিয়েছেন ঠিক নজরুলের ভাব ও আবেগের মিশ্র অনুপানে নির্মিত এক অনন্য সাধারণ প্রেমের মদিরা। প্রিয়ার মাদকতাপূর্ণ এক পলক চাহনি আর তার উচ্চারিত একটি মাত্র শব্দের সাথে তুলনা করেছেন পুরো দুনিয়ার জ্ঞানভাণ্ডারকে। অথচ জ্ঞানের কাছে কবি নিজেও ছিলেন অবনত! তারপরও গ্যাটে বলেছেন-

‘ওয়ান গ্লান্স, ওয়ান ওয়ার্ড ফ্রম ইউ
গিব্স মোর প্লেজার দ্যান অল দ্য উইসডম অব দিস ওয়ার্ল্ড’

আমি এর অনুবাদ করেছি এভাবে-

‘মূহুর্তে বিলীন সকল বিদ্যা
এই জগতের জ্ঞানের আলোক,
তুমি যদি বল একটি শব্দ
অথবা তাকাও একটি পলক !’

একই অনুভুতির পুনরাবৃত্তি দেখতে পাই জনৈক উর্দু কবির কবিতায়। তার আবেগ আরো বেশি গতিসম্পন্ন, আরো বেশি করুণ! প্রিয়ার প্রেমে আকন্ঠ নিমজ্জিত কবির কণ্ঠ থেকে নিসৃত হচ্ছে একাকিত্বের পদাবলী-

‘ইস্ তানহাইমে মুঝে রাহত দেতি হ্যায় হাওয়া
উসনে তেরি জিসমে চুমকর আয়ি হ্যায়’

যার অর্থ হলো-
এই একাকীত্বের মাঝেও আমি একটু শান্তি পাচ্ছি
বাতাসের কাছ থেকে, কারণ;
সে যে তোমাকে ছুঁয়েই এসেছে!’

সত্যিই প্রিয় মানুষের কথা, তার কণ্ঠস্বর, মুখাবয়ব, ঘ্রাণ, স্পর্শের অনুভূতি আমাদের বারবার মনে করিয়ে দেয় তাকে আমি ‘ভালোবাসি!’ শত ব্যস্ততা আর নাগরিক জীবনের নানা ঝামেলার পরও একটু অবসর পেলেই এসব অনুসঙ্গ যেন আমাদের বন্দী স্মৃতির বাক্স থেকে থলের বিড়ালের মত সুরসুর করে বেরিয়ে পড়ে চুপিসারে।  মুখে না বললেও মন ঠিক মেহেদী হাসানের গাওয়া গানের ইন্দ্রজালে আটকে যায়। হঠাৎ সবার অলক্ষ্যেই গুনগুন করি আমরা -

‘হারানো দিনের কথা মনে পড়ে যায়
পারি না বোঝাতে মনে
কি যে করি হায়!’

একটু পরনো অথচ আধুনিক বাংলা গানের কথাও মিলে যায় হুবহু-

‘মিষ্টি একটা গন্ধ রয়েছে ঘরটা জুড়ে
না জানিয়ে এসে
কাউকে না পেয়ে গেছে কি ঘুরে ’

এখানে শরীরী প্রেমের জায়গা কোথায়? ভিন্ন মানে না খোঁজ করলে মিষ্টি গন্ধটিই তো যথেষ্ট। তাকে ঘিরেই তো তৈরি হয়েছে এক ভিন্ন আবহ যা এক ধরনের অস্পৃশ্য মোহের মত যা অক্টোপাসের মত আষ্টেপৃষ্টে নিজেকে আকৃষ্ট করে রাখে। প্রিয়ার রেখে যাওয়া ঘ্রাণে নিজেকে সর্বদা করে রাখে ঘ্রাণময়!
07
তার অনুপস্থিতিতে তার প্রেমিকা এসে ঘুরে গেছে তারই ঘরে। প্রেমিকার দেখা না পেলেও প্রেমিক ঘ্রাণ শুকেই বুঝে নিয়েছে যে সে এসেছিল। তার মনের মানুষের দেখা না পাক তবু তার শরীরের সুবাসটাতো ছড়িয়ে গেছে সারা ঘরময়। হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির মত এই ঘ্রাণটুকুকেই সে বারবার মনে করে। যেন প্রেয়সীর শরীরের ঘ্রাণ তার অলক্ষ্যেই নিজের শরীরে লেগে আছে। এটুকুই বা কম কিসে? আমাদের অনেকের ব্যক্তিগত জীবনেও এমন স্মৃতি আজো অক্ষত। অনেকটা ঠিক ধুলোজমা বালকবেলার পাঠ্য বইয়ের মত। একই সাথে মূল্যহীন এবং মূল্যবান। একইভাবে প্রিয় মানুষটির স্মৃতি একই সাথে তুচ্ছ এবং মহা মূল্যবান! যারা প্রেম বলতে শুধুই শরীরকে ভাবেন, তাদের কাছে এমন প্রেম তুচ্ছ বই কিছু নয়। কিন্তু প্রেমে যাদের আস্থা, যারা শরীরিক সম্পর্কের বাইরেও এই অনুভুতির স্বাদ নিতে চায়, তাদের কাছে এটি মহামূল্যবান।

যাকে ভালোবাসা যায় তার স্মৃতিকে সযত্নে রক্ষিত করা যায় হৃদয়ের গহীন ভেতরে। স্পর্শ না করেও তাকে ছোয়াঁ যায় অলৌকিক উপায়ে। অনেক লোকের মাঝেও তার দিকে ব্যক্তিগত চোখে তাকানো যায়, বিনিময় করা যায় অব্যক্ত সব কথামালা। মনে মনে আলতো স্পর্শ করা যায় তার কোমল হাতের আঙুল, কল্পলোকের মাঝে আদর করা যায় তার চিবুক ছুঁয়ে। চোখে চোখ মিলে যাওয়ার যে বিদ্যুৎস্পর্শ, ক্ষণকাল দৃষ্টি বিনিময়ের মধ্যে যে নিবিড়তর আলিঙ্গন, সে কি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিতে পারে কখনো? যদি তাই হতো তবে; প্রেম মানেই বোঝাতো শরীর, দেহের সাথে দেহের মিলন। আর কাছে পেলেই নারী-পুরুষের দৈহিক সম্পর্ক স্থাপিত হতো কোনও বিপত্তি ছাড়াই। এবং তাহলে আত্মা বা হৃদয় নামের বস্তুটিকে কবেই পৃথিবী থেকে চির বিদায় নিতে হতো! অথচ, যুগে যুগে এমনকি এই মোবাইল, কম্পিউটার, স্যাটেলাইট আর অনলাইনের যুগেও অদৃশ্য এবং অধরা এক বস্তু বা বিষয়কে ধরার জন্য, চেনার জন্য, কত অভিযানই না চলছে। তাকে ধরা যাবে না বা তার দেখা পাওয়া যাবে না জেনেও সবাই তার পেছনে ছুটছে। যেন যে কোনও মূল্যে ধরতে পারলেই হলো একবার। সাধক লালন তার অধরা প্রেমিক আত্মার খোঁজ করতে করতে অবশেষে তাই গেয়েছেন-

‘খাঁচার ভিতর অচীন পাখি ক্যামনে আসে যায়
তারে ধরতে পারলে মনো বেড়ি
দিতাম পাখির পায়’

খোঁজ শেষে লালন বলেছেন-

‘বাড়ির কাছে আরশিনগর
সেথা এক পড়শি বসত করে,
আমি একদিনও না দেখিলাম তারে...

 আবার বলেছেন-
‘সে আর লালন একখানে রয়
তবু লক্ষ-যোজন ফাঁক রে...

কী ভয়ঙ্কর কথা দেখুন। এখানে প্রেমিক তার প্রেমিকার সাথে মিলিত হবার কথা নিজেই ব্যক্ত করছেন অথচ আবার বলছেন- তারা এক স্থানেই ছিলেন কিন্তু, দু’জনের মধ্যে যোজন যোজন দূরত্ব ছিলো যা তারা ভেদ করতে পারেননি!

সাধক লালনের এই প্রেমও তো কোনও লৌকিকতার সীমা দ্বারা বেষ্টিত নয়। তবে তা  অবশ্যই অলৌকিক বা অশারীরিক। সুতরাং ঈশ্বর প্রেমের সংজ্ঞার ছাঁচে এটি সন্দেহাতীতভাবে প্লেটোনিক প্রেমেরই এক ভিন্ন রূপ যা আমরা অন্য আরো অনেক সাধু পুরুষের সাধনায় দেখতে পাই।

অদৃশ্য ও অস্পৃশ্য সেই অধরা মহান স্রষ্টার সাথে মিলিত হবার বাসনায়, তাঁর সান্নিধ্য লাভের লক্ষ্যে অলৌকিক পরমকে খুঁজতে গিয়ে মনসুর আল হাল্লাজ তো বলেই ফেললেন ‘আনাল হক’ বা ‘আমিই সত্য!’ সেই সত্যের ভেতরে প্রকৃতপক্ষেই কোনও ধ্রুবসত্য লুকায়িত ছিলো কি না- তা অন্য কেউ আর খোঁজ করতে গেলেন না কেন? কারণ সে সত্য আবিষ্কার করতে হলে নিজের সত্ত্বাকে বিসর্জন দেবার ভয় রয়েছে, রয়েছে লৌকিকতার বেড়াজাল থেকে বেড়িয়ে যাবার চরম ভয়!

আমরা যাকে প্লেটোনিক প্রেমের অভিধায় আখ্যাায়িত করছি এই লৌকিক মানুষি প্রেমের ভিত্তিমূলেও রয়েছে ঠিক এমন প্রবল ভয়। সামাজিকভাবে অপমানিত হবার ভয়, পরিবার থেকে অবরোধ-প্রতিরোধের ভয়, সর্বোপরি নিজের জীবনে চরম হতাশা বা দুর্দশা নেমে আশার ভয়। এসব জেনে কেউ কি এমন সর্বনাশা প্রেমে হাবুডুবু খেতে চাইবে? সর্বোপরি শুধুমাত্র হাবুডুবু নয়, রীতিমত অকুল পাথারে ডুবে মরার ভয় যেখানে অহরহ বিদ্যমান! এমন ভয়কে জয় করার দুঃসাহস খুব কম লোকই দেখাবে, এটিই স্বাভাবিক।
01
এসব ব্যতীতও প্লেটোনিক প্রেম নিয়ে অনেকের মনে রয়েছে নানা বিভ্রান্তি। এই অবকাশে তা কিছুটা দূর করা যেতে পারে।

কোনও প্রেম গার্হস্থ্য সীমার ভেতরে এসে পৌঁছায়নি বলেই কিন্তু তাকে নিষ্কাম প্রেম বা প্লেটোনিক প্রেম বলা যাবে না। মনের মানুষকে সমাজের অনুশাসনের বাঁধা অতিক্রম করে কাছে না পাওয়ার ঘটনা অনেকের জীবনেই ঘটে থাকে। না পাওয়ার এই ঘটনা অনেককে ‘দেবদাস’ করে তোলে আবার কেউ বা অতি কষ্টে ভুলে যেতে সক্ষম হন। কেউ আবার তার স্মৃতিকে সযতেœ তুলে রাখেন হৃদয়ের  মণিকোঠায়, দীর্ঘশ্বাসের গোপন ঝাঁপিতে। এখানে দেবদাস ও পার্বতীর প্রেমের কাহিনীকে উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করা যায়।

জীবনের এক পর্যায়ে পার্বতী বিহনে দেবদাসের জীবনে সর্বনাশের ধস নেমেছিল। কিন্তু এর পেছনে কতটা প্রেম হারানোর দুঃখ এবং কতটাই বা পরাজয়ের জ্বালা ছিল কে তার সঠিক হিসেব দেবে? অন্যদিকে যে দেবদাসের জন্য পার্বতীর বুকের পরম গভীরে নিভৃতে প্রেমের কুসুম লুকানো ছিল, সেই উড়নচণ্ডী স্বভাবের দেবদাসের ঘরনী হলে পারু কতখানি সুখী হতো তা নিয়েও রীতিমত সংশয় থাকতে পারে। তাই দেবদাস-পার্বতীর প্রেমও ঠিক অতীন্দ্রিয় প্রেম নয়।

আরো পরিষ্কার করে বললে- কোনওমতে যদি তাদের বিবাহের ক্ষেত্রে মিলে যেতো সমাজের ছাড়পত্র, তাহলেই কিন্তু তাদের ভালোবাসায় এসে পড়তো শরীর প্রসঙ্গ। সর্বোপরি সাধারণ আর দশজনের মতই সাংসারিক টানাপড়েন, ছেলেপুলে, বিষয়-আশয় নিয়ে ব্যস্ত এক দেবদাসকে আমরা পেতাম। বিরহী প্রেমের নায়ক আর অনেকের আদর্শ দেবদাসকে হয়তো আমরা পেতাম না। সুতরাং এখানে দেবদাসও প্রেমের পরিমাপে  পুরোপুরি প্লেটোনিক প্রেমিক হতে পারেননি।

অনেকেই এবার প্লেটোনিক প্রেমের সঠিক সংজ্ঞা জানতে আগ্রহী হয়ে উঠবেন। জানতে চাইবেন তা হলে এর সংজ্ঞাটি কী?

জবাবে বলা যায়- প্লেটোনিক প্রেম অর্থাৎ অতীন্দ্রিয় প্রেম বা দেহবিহীন প্রেম বলা যাবে তাকেই, যা পরস্পরের প্রতি কখনই আরোপ করবে না অধিকার বোধ, আশা করবে না প্রতিদান। বিবাহের মধ্য দিয়ে পরিপূর্ণতা পেতে কখনোই চাইবে না। এমন একটা সম্পর্ককেই মূলত: প্লেটোনিক প্রেমের সংজ্ঞায় বেঁধে ফেলা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বললে-

‘আমার প্রেম রবি কিরণ হেন
জ্যোতির্ময় মুক্তি দিয়ে তোমারে ঘেরে যেন!’

এই  জ্যোতির্ময় মুক্তিই প্লেটোনিক প্রেমের সব থেকে বড় অভিধা।

কিন্তু আমাদের দৈনন্দিনতা কখনো কখনো জীবনটাকে খুব উগ্র করে তোলে, ক্লেদাক্ত করে তোলে মাঝে মধ্যেই। তখন আমাদের ভালোমানুষির আড়ালে লুকিয়ে থাকা সুপ্ত পিশাচটার আকষ্মিক ঘুম ভাঙ্গে। আর ভেতরে জেগে উঠতে থাকে এক সর্বগ্রাসী ক্ষুধা। ভালোবাসার প্রেয়সিকেও তখন আমরা তীব্র কামজ্বালা মেটানোর নিমিত্তে স্রেফ মন্থনযোগ্য এক শরীরের আদলে দেখতে শুরু করি। তখন নরম কমনীয় লোভের অতীত প্রেমও এই মহাক্ষুধার আঁচে পুড়ে অংগার হয়ে ওঠে। কুৎসিত আর ভয়ঙ্কর সেই প্রেম শুধুই শরীর চায়, অধিকার পাওয়ার নেশায় উন্মত্ত হয় এবং তরল সুখ আর প্রমোদে মেতে উঠতে মরিয়া হয়ে পরে। তখন প্রেমের ভাষ্য হয়ে উঠে-

‘আমি তারে ভালোবাসি অস্থিমজ্জাসহ
আমিও রমনীর রূপে
আমি ওই মাংস স্তুপে
কামনায় কামনীয় কেলি কালীদাহ।’

কামনার এই নাগপাশ দিয়েই সে তখন ভালোবাসার মানুষটিকে বাঁধতে চায়। হাজারো বিধি নিষেধের জালে আবদ্ধ রেখে নিজে তার সুখ পেতে চায়।

তবে, তার মানে যদিও এই নয় যে, শুধুমাত্র যে সম্পর্ককে শরীরি প্রাপ্তির সীমায় পাওয়া যাবে না তাকেই নিষ্কাম প্রেম বলতে হবে। পাওয়া না পাওয়ার হিসেব নিকেশ যে সম্পর্ককে কালো ছাযায় আচ্ছন্ন করে না, স্পর্শের নাগালে পাওয়ার কোনও আকুলতাই যে সম্পর্ককে ব্যাকুল করে তোলে না, কামগন্ধহীন সে প্রেমের ভাষ্য হলো-
02
‘আমি রূপে তোমায় ভুলাবো না
ভালোবাসায় ভোলাবো,
হাত দিয়ে দ্বার খুলবো নাকো
গান দিয়ে দ্বার খোলাবো।’
ভালোবাসার এমন  প্রলেপ পাবার জন্য শরীর তেমনটা দরকারী নয়, দরকারী নয় নিবিড় সান্নিধ্যও। কবির ভাষায়-

‘সারা পৃথিবী আমায় ভুল বুঝলেও
অপরাধি মনে করলেও
যার হৃদয়ে আমি চির মহিমান্বিত হয়ে থাকবো
শুধু তাকে মনে করলেই  সব দুঃখ বেদনা উধাও
হৃদয়ের গোপন প্রকোষ্ঠের রক্তপাত মুহূর্তেই বন্ধ!’

বহুকাল ধরেই নানা উদাহরণ, যুক্তি ও ব্যাখ্যা দ্বারা প্লেটোনিক প্রেমকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এর পক্ষে বা বিপক্ষেও রয়েছে অনেক যৌক্তিক ব্যাখ্যা। থেমে নেই আলোচনা, গবেষণা, অনুসরণ-অনুকরন আর বিতর্কের ঝড়। রুমাল বা পত্র বিনিময়ের যুগ পার হয়ে অনলাইন, মোবাইল, ইন্টারনেটের অত্যাধুনিক এ যুগের প্রেমিক-প্রেমিকাদের মধ্যেও রয়েছে প্লেটোনিক প্রেমকে জানার প্রবল আগ্রহ। আবার কেউ কেউ এমনও আছেন যে আলোচনার প্রারম্ভেই বাতিল করে দেবেন অশারীরিক বা অতীন্দ্রিয় এই ভালোবাসাকে।

সবশেষে, পাঠকের অনুমতি নিয়ে, জগজিৎ সিংয়ের মদিরামাখা কণ্ঠে গীত কবি শহীদ কবিরের লেখা এ শেরটি দিয়ে শেষ করতে চাই

‘বে সাবাব বাত বারহানি কি জরুরত কিয়া হ্যায়
হাম খাফা কাবথে মানানে কি জরুরত কিয়া হ্যায়...

দিলসে মিলনেকি, তামান্নাহে নেহি জব দিলমে
হাতসে হাত মিলানেকি জরুরত কিয়া হ্যায়!

রঙ্গ আঁখোকে লিয়ে বুহে দামারোকে লিয়ে
ফুলোকো হাত লাগানেকি জরুরত কিয়া হ্যায়!’

বাংলাদেশ সময়: ২০৩৮ ঘণ্টা, ০৮ ডিসেম্বর, ২০১১
















বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

মুক্তিযোদ্ধার সম্মান চাই সারা বছর

মুক্তিযোদ্ধার সম্মান চাই সারা বছর


আসাদুল হক খোকন
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
স্বাধীনতা আর আমি বয়েসে দু’জন প্রায় সমান। আমাদের জন্মের ব্যবধান মাত্র এক মাসের। অর্থাৎ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যখন পাকিস্তানি বর্বরদের হাতের মুঠোয় বন্দি তখন আমি মায়ের পেটে। তাই স্বাধীনতার জন্য কী অর্বণনীয় কষ্ট আর ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে, তা জানেন আমার মা। জানেন তারই মতো আরো অসংখ্য বাঙালি মা।
তারা জানেন, সন্তান পেটে নিয়ে পাকি সেনা ও বাঙালি রাজাকারদের ভয়ে কী করে প্রতিটি মুহূর্ত পার করতে হয়েছে, কী রকম অসহায় লাগে দিনের পর দিন নিজের বাড়ি ঘর ছেড়ে বনে-বাদাড়ে পরিবার পরিজন নিয়ে লুকিয়ে থাকতে, কী দুঃসহ যন্ত্রনা হয় মা-বাবার সামনে তার আদরের নিস্পাপ শিশু সন্তানকে হত্যা করলে, সম্ভ্রম হানি করলে, ধরে নিয়ে গুম করে ফেললে। আমি তো তখন কেবলি শিশু, আমি তাই এসবের কিছুই জানি না। আমার মতো হাজারো মানুষ যাদের জন্ম স্বাধীনতার সময় অথবা পরে অথবা তখন অবুঝ, তারাও এসবের কিছুই জানেন না!
আমাদের বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমরা ইতিহাস জানতে শুরু করেছি। ভাষাদিবস, স্বাধীনতাদিবস, কালরাত্রি এবং বিজয়দিবস সম্পর্কে জেনেছি অথবা আমাকে জানানো হয়েছে। কে প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, কে প্রথম পতাকা উত্তোলন করেছিলেন, কে কে রশি ধরেছিলেন, কে পতাকার বাঁশ দিয়েছিলেন এসব নিয়ে রীতিমত আরেকটি যুদ্ধ সংগঠিত হবার যোগাড়! স্বার্থপরতার চরম পরিচয় দিয়ে একটি রাজনৈতিক দল দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ধরে তাদের নেতাই যে প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, এই মিথ্যেকে সত্যে পরিণত করার আন্দোলনে উন্মাদ হয়েছে। বারবার ভুল ইতিহাস তুলে ধরে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছে। অথচ স্বাধীনতার কয়েক যুগ পার হলেও স্বাধীনতার জন্য যারা আত্মত্যাগ করেছেন, পরিবার হারিয়ে, সহায় সম্বল হারিয়ে নিঃস্বের মতো জীবন কাটিয়েছেন, তাদের খোঁজ নেয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি।
পত্রিকায় খবর ছাপে- ‘মুক্তিযোদ্ধা ওমুক এখন পথে পথে ভিক্ষে করছেন’। তা পড়ে মুক্তিযোদ্ধাসহ (সবাই না) সাধারণ মানুষ আফসোস করেছেন। অনেকে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের মর্মর্স্পশী স্মৃতি মনে করে নিভৃতে চোখ মুছেছেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেই নিজের কাছে প্রশ্ন করেছেন- এমন স্বাধীনতা কি আমরা চেয়েছিলাম?
স্বাধীনতার জন্য যারা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন, প্রতিদানের পরিবর্তে তাদের ওপর তারা প্রতিশোধ নিয়েছেন নানাভাবে। স্বাধীনতার পর প্রতিদান হিসেবে প্রথমেই স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। তারপর হত্যাকারীদের আশ্রয়, পূনর্বাসন এবং ইনডেমনিটি বিল পাশ করে এই নৃশংস হত্যাকে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা দখল করা হয়েছে। স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকারদের গাড়িতে আমাদের জাতীয় পতাকা উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। একের পর এক রাজাকাররা ধনী থেকে আরো ধনাঢ্য হয়েছে। আর মুক্তিযোদ্ধারা ক্রমাগত দরিদ্র থেকে দরিদ্রতম!
উপরের উদাহরণগুলোকে একটু মনোযোগ দিয়ে পড়লেই বোঝা যায়, জাতি হিসেবে এমন অকৃতজ্ঞ ও এমন নিমক হারামীর প্রকৃষ্ট উদাহরণ বিশ্বে আর দ্বিতীয়টি নেই।
আমরা কি এই স্বাধীনতা চেয়েছিলাম? পাকিস্তানের মত বন্দুকের জোরে মেজর থেকে জেনারেল তক সরকারের চাকররা ক্ষমতায় বসে বারবার আমাদের নিতম্বে লাথি কষবেন! স্বাধীনতার ৪০ বছর পরেও রাষ্ট্রের কাছে ভিখিরির মত অনুনয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাইতে হবে! বিজয়দিবসে সারা দেশে লাখ লাখ টাকা খরচ করে অনুষ্ঠান করা হবে অথচ অসহায়, পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনের টাকাও হবে না।
দেশ স্বাধীন হওয়ার সনটিও বলতে পারেন না, যাদরে রিক্সায় চড়ার মুরোদ হবার কথা না-  এমন নামধারী যেনতেন ছাত্রনেতাদেরও আজকাল পাজেরো গাড়ি হবে। কিন্তু, মুক্তিযোদ্ধার শিক্ষিত সন্তানদের একটি বাইসাইকেল কেনারও সামর্থ্য হবে না।
চরম অপমানের ব্যাপার হল, আর্থিক বা অন্যান্য সুবিধা দূরের কথা, অনেক ক্ষেত্রেই প্রাপ্য সম্মানটুকুও জানানো হয় না তাদের!

কিন্তু কেন? কী তাদের অপরাধ?  জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করা? এখন তো স্বাধীনতার পক্ষে যারা রয়েছেন রাষ্ট্র ক্ষমতা তাদের হাতেই। তাহলে এতগুলো বছর পরেও কেন আমাদের মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারগুলো ভালো থাকবে না, সম্মান জানানো হবে না? কত কত ফালতু কাজে টাকা খরচ হচ্ছে? অথচ তাদের বেলায় টাকা নেই। কেন? তারা তাদের রাইফেলগুলো জমা দিয়ে দিয়েছেন বলে? কব্জির জোড় কমে গেছে বলে?

স্বাধীনতার ৪০ বছর পূর্তিতে আমি রাজনীতিবিদ এবং যেসব মুক্তিযোদ্ধা সুবিধাজনক অবস্থানে আছেন, তাদের কাছে এ প্রশ্নটি করতে চাই।
চল্লিশতম বিজয়ের উৎসব গত হয়েছে, আজ (১৭ ডিসেম্বর) থেকে হয়তো আগামী বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত তাদের কেউ খুব একটা স্মরণও করবেন না। আমাদের গৌরবোজ্জ্বল বিজয়ের ৪ দশক পূর্তিতে শ্রদ্ধেয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সশ্রদ্ধ সালাম! আশা করি অন্যরাও এর থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তাদেরকে অন্তত সারা বছর জুড়ে প্রাপ্য সম্মানটুকু জানাবেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৩০২ ঘণ্টা, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১১
















বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।



সালতামামি আনন্দ বেদনার দ্বৈরথে বিদায় ২০১১!

সালতামামি

আনন্দ বেদনার দ্বৈরথে বিদায় ২০১১!


আসাদুল হক খোকন, নিউজরুম এডিটর
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আর মাত্র ক’দিন বাকি। ঝরা পালকের মতো আমাদের জীবন থেকে ঝরে পড়বে আরও একটি বছর। এক মুহূর্তেই বদলে যাবে ৩৬৫ দিনের ছকে বাঁধা নানা পরিকল্পনা, আশা-নিরাশা, পাওয়া-না পাওয়া আর ঘটনা-দুর্ঘটনার বছর ২০১১ এর পুরনো ক্যালেন্ডার।
তার স্থান দখল করবে ২০১২ এর নতুন পঞ্জিকা!
কিন্তু পুরনো ক্যালেন্ডার সরিয়ে ফেললেও সরানো যায় না পুরনো বছরের ঘটে যাওয়া ঘটনাবলি। আমাদের প্রিয়জন, শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় আমাদের হৃদয়ে ঠাঁই করে নেওয়াদের মধ্যে অনেককে ২০১১ সালে হারিয়েছি, তেমনি অনেকেই নানা অর্জন, ত্যাগ ও ভালোবাসায় জায়গাও করে নিয়েছেন হৃদয়ের কন্দরে। এসব নিয়ে বছর শেষের আগেই দেনা-পাওনার মতো আমরা হিসেব করতে থাকি স্মৃতির মণিকোঠায় জমে থাকা- সালতামামি- ২০১১।
সে বিচারে নানা বৈচিত্রময় ঘটনা-দুর্ঘটনা, সুখ-দুঃখ, আলোচনা-সমালোচনায় ঠাসা ২০১১ কে একবাক্যে ঘটনাবহুল বলা যায়। তবে জাতি হিসেবে বিস্মৃতিপরায়ণ বলে আমরা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ভুলে যাই। আবার কখনো বা তুচ্ছ ঘটনাকেও ভাবি মহামূল্যবান। তবে জটিল গুরুগম্ভীর সে তর্কে না গিয়ে ২০১১ এর গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটনা আপনাদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

মাতৃত্বকালীন ছুটি ৬ মাস: ইতিবাচক
maternityবছরের শুরুতেই শেখ হাসিনা সরকার মায়েদের বাড়তি সুবিধা বিবেচনা করে ৪ মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটিকে বাড়িয়ে ৬ মাস করেছেন। এতে নারীরা তাদের ন্যায্য অধিকার পেয়েছেন বলে মনে করেছেন অনেকেই। বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন অন্যেরাও। এবং সম্ভবত এই একটি বিষয়ে কোনও নেতিবাচক মন্তব্য করা থেকে বিরত থেকেছে বিরোধী দল বিশেষ করে বিএনপি ও তার অঙ্গসংগঠন। অথবা গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টির প্রতি তাদের দৃষ্টিই পড়েনি!
বছরজুড়ে বিএনপি ও তার অঙ্গসংগঠন ভিন্ন ভিন্ন ইস্যু নিয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলনের নানা কর্মসূচি দিলেও গড়পরতায় এর সবই পালিত হয়েছে খুবই ঢিলেঢালাভাবে। অন্যদিকে কোনো কোনো কর্মসূচিতে সরকারি বাধা বা প্রতিরোধও খুব একটা ভালো চোখে দেখেননি অনেকেই। তবে বছর শেষে বিএনপির মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশকে ঘিরে পুলিশি বাধা এবং অন্যদিকে গাড়িতে আগুন দিয়ে নিরীহ মানুষ পুড়িয়ে মারা ২০১১ কে কলঙ্কিত করেছে।
ডালমে কুচ কালা হ্যায়!
জনবহুল দেশ হিসেবে পরিচিত দেশের মোট জনসংখ্যার হিসেব জানতে এ বছর পরিচালিত হয়েছে আদমশুমারি ২০১১। প্রাপ্ত হিসেব অনুযায়ী দেশের বর্তমান মোট জনসংখ্যা ১৪,২৩,১৯,০০০জন , পুরুষ ৭,১২,৫৫,০০০ জন এবং ৭,১০,৬৪,০০০ জন মহিলা বলে জানানো হয়। তবে বেসরকারি সংস্থাগুলোর মতে দেশের জনসংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি। সরকার পরিচালিত অতীতের আদমশুমারি নিয়েও তাদের মতামত অভিন্ন পরিলক্ষিত হয়েছে। এ নিয়ে বিভিন্ন মহলের মনোভাব হচ্ছে ‘ডালমে কুচ কালা হ্যায়’!
বিশ্বকাপে স্বাগতিক টাইগারদের ‘মার্জার রূপ’
world২০১১ সনের উল্যেখযোগ্য ঘটনাগুলোর মধ্যে আর একটি হলো- বিশ্বকাপ ক্রিকেট। কয়েকটি দেশের পৃথক ভেন্যুতে অনুষ্ঠিত এ খেলায় স্বাগতিক দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের পারফর্মেন্স ছিল খুবই বাজে। কাগুজে বাঘদের মার্জারবৎ পারফর্মেন্সে চরম হতাশ দেশের অগুনতি ক্রিকেট ভক্ত খেলা দেখাই প্রায় ছেড়ে দেন! এনিয়ে এখানে বিস্তারিত চর্চা তাদের পুরনো ক্ষতে নুনের ছিটার মতই মনে হতে পারে, তাই এ নিয়ে আর কথা না বাড়ানো সমীচীন মনে হচ্ছে।

আলোচিত আরও সব ঘটনা
doelবিরোধী দলের নিরুত্তাপ হরতাল পালন, র্যাব-লিমনের ঘটনা, মীরসরাই ট্রাজেডি, রূপগঞ্জে জমি নিয়ে এলাকাবাসীর সঙ্গে র‌্যাব-পুলিশ ও সেনা সদস্যদের মধ্যে সংঘর্ষ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাতিসংঘের সাউথ সাউথ পুরস্কার লাভ, সুন্দলপুরে দেশের ২৪তম গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার, নতুন ৫ জাতীয় অধ্যাপক নিয়োগ, দেশের প্রথম ল্যাপটপ দোয়েল উৎপাদন শুরু, ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফর, মালদ্বীপে বাংলাদেশের জাতীয় স্মৃতিসৌধ স্থাপন,  জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনের ঢাকা সফর, আড়িয়াল বিলে বিমান বন্দর নির্মাণকে কেন্দ্র করে জনতা-পুলিশ সংঘর্ষ ও পরে সরকারের সেই অবস্থান থেকে সরে আসা, যুক্তরাজ্যের নিউজার্সি সিনেট কর্তৃক খালেদা জিয়াকে বিশেষ সম্মাননা প্রদান, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সেলিনা হায়াত আইভীর বাজিমাত, সারাদেশে তীব্র মাত্রার ভূমিকম্প, বাংলাদেশ মহিলা ক্রিকেট দলের ওয়ানডে স্ট্যাটাস লাভ এবং উপমহাদেশ ভাগের ৬৪ বছর পর দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়া প্রভৃতি ছিল ২০১১ সালের উল্যেখযোগ্য ঘটনাগুলোর অন্যতম।
নারায়ণগঞ্জে আইভীর বাজীমাৎ
ivyতবে অবশ্যই সাম্প্রতিক সময়ে অন্যান্য ঘটনা ছাপিয়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরশন নির্বাচন যেভাবে পুরো জাতিকে আলোড়িত করেছে তা এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা হয়ে থাকবে। এ নির্বাচনে বিপুল বিজয়ের মাধ্যমে ডা. সেলিনা আইভী শুধু নবগঠিত এ পৌরসভার প্রথম মেয়রই নির্বাচিত হননি, তিনি দেশের প্রথম নারী মেয়রও নির্বাচিত হন।
টিপাইমুখ নিয়ে সরগরম সব দল
tipaimukhশুরু থেকে বছরের শেষ পর্যন্ত মাঝে মাঝেই টিপাইমুখ ইস্যু নিয়ে আলোচনা-সমালোচনায় সরগরম থেকেছে রাজনৈতিক অঙ্গন। বিরোধী দল ইস্যুটিকে কাজে লাগিয়ে কিছু সরকার বিরোধী আন্দোলনকে বেগবান করার চেষ্টা করলেও তা ছিল প্রত্যাশার তুলনায় ‍তা ছিল দায়সারা।
অন্যদিকে সরকারের মুখপাত্রসহ কেউ কেউ টিপাইমুখ পরিদর্শনেও গিয়েছেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভারত টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণের সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেছে। অর্থাৎ, বলা যায় টিপাইমুখ বন্ধ করতে গিয়ে নিজেদের মুখ বন্ধ করে ফিরে আসেন তারা!
লিমন-সাভার-কাদের-মিলন: র‌্যাব-পুলিশের কৃতিত্বে কলংক তিলক
savarবছরজুড়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বিশেষ করে পুলিশ এবং র‌্যাব আলোচিত-সমালোচিত হয়েছে। ছিনতাইকারী, মাদক ব্যবসায়ী, অপহরণকারী, ধর্ষক, খুনীসহ বিভিন্ন অপরাধী আটক ও তাদের আইনের বিচারের মুখে সোপর্দ করে র‌্যাব সুনাম অর্জন করলেও লিমনের ঘটনায় তাদের সে সুনাম অনেকখানিই ক্ষুন্ন হয়েছে।
অন্যদিকে শবেবরাতের রাতে সাভারে ৬ ছাত্রকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যার সময় হত্যাকারীদের সহায়তা দান করার ঘটনা পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা বিশেষ করে ছাত্রদের ডাকাত সাজানোর চেষ্টা ছিল এর মধ্যে অন্যতম। ডাকাত সন্দেহে নিহত ৬ জনকে পরবর্তীতে আদালত ছাত্র বলে রায় দিলে পুলিশের ভূমিকা ফাঁস হয়ে যায়।
একইভাবে আবদুল কাদের নামের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রকেও ছিনতাইকারী বলে পুলিশ আটক করে। পরে তার পায়ে চাপাতি দিয়ে আঘাত করা হয় এবং তার নামে মিথ্যা মামলাও করে পুলিশ।
কোম্পানীগঞ্জে ডাকাত সন্দেহে গণিটুনিতে শামছুদ্দীন মিলন(১৬) নামে এক নিরপরাধ কিশোর নিহত হওয়ার ঘটনা মিডিয়ায় ব্যাপক আলোড়ন তোলে। মামলার আরজিতে বাদী চর ফকিরা গ্রামের প্রবাসী গিয়াস উদ্দীনের স্ত্রী কোহিনূর বেগম উল্লেখ করনে, গত ২৭ জুলাই সকালে শামছুদ্দীন মিলন জমি রেজিস্ট্রি করতে বাড়ি থেকে ১৪ হাজার টাকা নিয়ে উপজেলা সদরে যায়। চরকাঁকড়া গ্রামের আকু মাঝি বাড়িতে থাকা খালাতো বোন চুমকির সঙ্গে কথা বলতে সকাল সাড়ে নয়টার দিকে স্থানীয় স্কুলের পাশের মসজিদ ঘাটে বসে অপক্ষা করছিল মিলন। এসময় স্থানীয় মিজানুর রহমান ওরফে মানিক শামছুদ্দীনের কাছে সেখোনে বসে থাকার কারণ জানতে চান।
একর্পযায়ে সেখানে আসেন স্থানীয় ইউনিয়ন পরষিদ (ইউপ) সদস্য জামাল উদ্দিন (ছোট জামাল)। একর্পযায়ে তারা পাশের বিদ্যালয় থেকে খালাতো বোন চুমকিকে ডেকে এনে তার পরিচয় সর্ম্পর্কে নিশ্চিতও হন। কিন্তু ইউপি সদস্য জামাল ও মিজানুর মিলনকে মারধর করে সঙ্গে থাকা টাকা ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেন এবং আহত অবস্থায় তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেন। অভিযোগে জানা গেছে, মোবাইল আর টাকা ইউপি সদস্য ও পুলিশের মধ্যে ভাগাভাগি হয়।
পরে পুলিশ তাকে নির্দয়ভাবে পিটিয়ে আহত করে এবং হাসপাতাল বা থানায় না নিয়ে স্থানীয় বাজারের কাছের তিন রাস্তার মোড়ে ফেলে দিয়ে যায়। এসময় সেখানে উপস্থিত লোকজন ডাকাত সন্দেহে শামছুদ্দীনকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করে। কিছুক্ষণ পর পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে নিরপরাধ মিলনের লাশ উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়। মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় ধারণ করা এ নির্মম ঘটনার দৃশ্য টিভি সংবাদে যারা দেখেছেন, তারা একবাক্যে স্বীকার করবেন, এ ঘটনা দুঃস্বপ্নকেও হার মানায়!
ঘটনা সম্পর্কে মিলনের চাচা জসিম উদ্দিন বলেন, ‘ওইদিন মিলন মোবাইল ফোনে তাকে আটকে রাখার কথা আমাদের জানিয়েছে। আমি তার মাকে নিয়ে ঘটনাস্থলে গেলে স্থানীয় লোকজন আমাদের জানায়, পুলিশ ইচ্ছাকৃতভাবে মিলনকে উত্তেজিত জনতার হাতে সঁপে দয়ে। পরে মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর আবার এসে লাশ নিয়ে যায়।’ এখানে এই ক্ষুদ্র পরিসরে মিলনের ঘটনাটি সবিস্তার বর্ণনা করা হলো এ আশায়- যেন আগামী বছর বা তার পরের বছরগুলোতেও এমন কোনও ঘটনা আর না ঘটে- যেখানে রক্ষকই নির্দয় ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়!
বিপদে নিরপরাধ মানুষের বন্ধু তথা সাহায্যকারী হওয়ার বদলে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী ‍বাহিনীর কিছু নীতিহীন সদস্যের এ ধরনের অমানবিক আচরণ আর অসৎ কারসাজি সমগ্র পুলিশ বা ৠাবের ব্যাপারে জনমনে বিরাজমান ভীতি ও অবিশ্বাস আরও মজবুত করে তোলে।
এ ধরনের বাস্তবতা পুলিশ বিভাগের বা ৠাবের অতীতের অন্য যে কোনও সুনাম নষ্ট করতে যথেষ্ট! একই সঙ্গে এ ধরনের ঘটনা আইন-শৃংখলা বাহিনীতে কর্মরত সৎ-কর্মনিষ্ঠ ব্যক্তিদের জন্য বিব্রতকর আর সাধারণ জনগণের জন্য হতাশা আর আতংকেরও।
খালেদার পুরস্কার প্রাপ্তি
khaledaবছরের মাঝামাঝি সময়ে বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিশেষ পুরষ্কার গ্রহণের উদ্দেশ্যে যুক্তরাজ্যের নিউজার্সি যাওয়ার ঘটনা আলোচনায় আসে। গণতন্ত্র, সন্ত্রাস দমন ও নারীর ক্ষমতায়নে তাকে যুক্তরাজ্যের নিউজার্সি অঙ্গরাজ্যের সিনেট এ পুরস্কার প্রদান করে। তবে; তার সমালোচকরা মনে করেন- নানা ক্ষেত্রে অবদানের জন্য শেখ হাসিনা বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশের বিশেষ পুরস্কার লাভ করলেও এর বিপরীতে তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বেগম জিয়া দীর্ঘ্যদিন ক্ষমতায় থাকলেও সেরকম কিছু পাননি। তাই এবার সে ঘাটতি মিটাতে তার ঘনিষ্ঠ মিত্ররা এই পুরস্কারের ব্যবস্থা করেন!



বেপরোয়া দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়া
অন্যান্য বছরগুলোর মতোই এবারও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বেড়েই চলেছে। বিষয়টি নিয়ে সংবাদপত্রসহ বিরোধী দল বেশ কয়েকবার সরকারকে বলার চেষ্টা করেছে। একপর্যায়ে  রমযান উপলক্ষ্যে ব্যবসায়ীরা ভোগ্যপণ্যের বাজাদর কমানোর প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে তারা তা করেননি। বরং কোনও কোনও পণ্যের দাম পূর্বের তুলনায় বেড়েছে। এমনকি রমযান ও ঈদুল আযহার পূর্বে কোথাও কোথাও স্বল্প সময়ের জন্য বাজার থেকে চিনি হাওয়া হয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে!

ফেলানী হত্যা: দেশ-বিদেশে ভারতীয় সমান্তরক্ষী বিএসএফ’র সমালোচনা
felaniবছরের অন্যান্য ঘটনাগুলোর মধ্যে সীমান্তে বিএসএফ এর গুলিতে বাংলাদেশি তরুণী ফেলানীর করুন মৃত্যু সমগ্র জাতিকে নাড়া দিয়েছে। জনপ্রিয় অনলাইন সংবাদপত্র বাংলানিউজ এ ঘটনায় প্রয়োজনীয় গুরুত্ব দিয়ে তথ্যনির্ভর সংবাদ প্রকাশে অগ্রণী ভূমিকা রাখে। পরে এ নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও সমালোচনার মুখে পড়তে হয় বিএসএফ তথা ভারতকে। এর ফলে ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করে এবং প্রতিশ্রুতি দেয় সীমান্তে অহেতুক গুলি করে নিরীহ বাংলাদেশিদের হত্যা না করার। কিন্তু বরাবরের মত প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি বিএসএফ। বছরের শেষ মাসেও সীমান্তে গুলি করে ৩ বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা।


তারেক-মিশুকের মর্মান্তিক মৃত্যু: আবুল-শাজাহান নির্ঘণ্ট
tarekমর্মান্তিক সড়ক দুঘটনায় প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক তারেক মাসুদ ও শহীদ মুনীর চৌধুরীর ছেলে বাংলাদেশে টিভি সাংবাদিকতায় আধুনিকতার পুরোধা মিশুক মুনীরের মৃত্যু সংস্কৃতি আর মিডিয়া জগৎসহ পুরো জাতিকেই শোকবিহ্বল করে। একই সঙ্গে মিরসরাইয়ে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় অর্ধশত কোমলমতি শিশু-কিশোরের নির্মম মৃত্যু জাতিকে শোকে হতবিহ্বল করে দেয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনও একক সড়ক দুর্ঘটনায় এতগুলি মৃত্যু, বিশেষ করে শিশু-কিশোরের মৃত্যুর ঘটনা আর ঘটেনি। এমনকি বিশ্বের অন্য কোনও দেশেও এ ধরনের ঘটনা বিরল। এছাড়া জুলাইয়ের শেষপ্রান্তে বগুড়ার শাহজাহানপুরের নন্দীগ্রামে বাস-ট্রাক সংঘর্ষে ১৮ জনের মৃত্যুর ঘটনাও শোকাবহ করে তোলে দেশের মানুষকে। এর আগের মাসে ট্রাকের সঙ্গে পিকআপের মুখোমুখি সংঘর্ষে একই উপজেলার ৯মাইল এলাকায় নির্বাচনী দায়িত্ব পালনরত পলিশের ৪ সদস্যসহ পিকআপ চালক নিহত হন।   
mishukএসব ঘটনার বিপরীতে তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী ‘আবুল’ এর দায়িত্বহীন মন্তব্য আর নৌমন্ত্রী শাহজাহানের গাড়ি চালকদের জন্য আলগা দরদ আর মায়াকান্না বিবেকবান মানুষকে ব্যথিত এবং একই সঙ্গে ভাবিত করেছে।
তবে বছরের শেষে আবুলকে অন্য মন্ত্রণালয়ে সরিয়ে দেয়া হলেও সাধারণ জনগণ খুশি হতে পারেনি। বছরজুড়ে সমালোচিত মন্ত্রীদের মধ্যে এবার আবুল ও শাহজাহান ছিলেন শীর্ষে! সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খানও ব্যাপক সমালোচিত হয়েছেন। বিশেষ করে বছরের শেষ প্রান্তে এসে রেলমন্ত্রী হওয়া একই দলের প্রবীণ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ফারুক খানকে উদ্দেশ্য করে ‘কম খান’ মন্তব্য বেশ আলোচিত ছিল।
তবে বছরজুড়ে নিজ দল ও সরকারের কৌশলী সমালোচনায় মুখর আওয়ামী লীগ নেতা সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত ও ওবায়দুল কাদের মন্ত্রী পরিষদে যুক্ত হওয়ার ঘটনায় সাধারণ্যে বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের মাঝে সন্তোষ লক্ষ্য করা গেছে।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যু
golamদীর্ঘদিন ধরে আলোচিত ইস্যু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। তবে এবার সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে এবং এজন্য গঠন করা হয়েছে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধে মানবতা বিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ দায়ের মামলায় এরই মধ্যে জামায়াতের আমীর মতিউর রহমান নিজামীসহ দলটির শীর্ষ কয়েকজন নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, অচিরেই গ্রেপ্তার হতে যাচ্ছেন ৭১ এ বাঙালিনিধন, ধর্ষণসহ নানান যুদ্ধাপরাধে হানাদার পাকিদের সহযোগী জামায়াতের সাবেক আমীর গোলাম আযমও।
একই অপরাধের অবিযোগে বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে গ্রেফতারের আগে এবং পরে সাকা চৌধুরীর ভাঁড়সুলভ মন্তব্য বরাবরের মতোই সংবাদ মাধ্যমগুলোর জন্য ছিল বেশ হট আইটেম!
গ্রীষ্মে বিদ্যুৎ সঙ্কটে অসহায় জনগণ
গ্রীষ্মের পুরো সময় ধরে বিদ্যুৎ সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছিল। প্রচণ্ড গরম আর ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং জনজীবন অতীষ্ঠ করে তুলেছিল। সামর্থ্যর্বানরা আইপিএস, জেনারেটর কিনে কষ্ট লাঘবে সচেষ্ট হয়েছেন তবে নিচের সারিতে থাকা মানুষ ছিলেন বরাবরের মত অসহায়। এসময় সুযোগ বুঝে, খারাপ মান ও বেশি দাম নিয়ে দেদারছে বাণিজ্য করেছে কিছু আইপিএস ও জেনারেটর বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান। অনেক গ্রাহক আবার কিনেছেন নবতর প্রযুক্তির সোলার প্যানেল। অপরদিকে, বিদ্যুৎ সমস্যার সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়ার সূত্রে ওয়াসার পানি সরবরাহে ঘাটতি ছিল এর মধ্যে বাড়তি সমস্যা।
যানজট
বছরজুড়ে রাজধানীতে যানজট লেগেই ছিল এবং আছে। যখন তখন রাস্তা বন্ধ, রিক্সার পথ পরিবর্তন ইত্যাদি পদক্ষেপের মাধ্যমে প্রসাশন এসমস্যা সমাধানের চেষ্টা করলেও মূলত সমস্যা কাটেনি। আর সদ্য প্রাক্তন নগরপিতা খোকার প্রায় বছরজুড়ে রাস্তা খোঁড়াখুড়ি নগরবাসীর যাতায়াত সমস্যাকে আগুনে ঘি ঢালার মতো বাড়িয়ে তুলেছে!েএকই সেঙ্গ সইতে হয়েছে মশার যন্ত্রণাও। সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ স্লোগানের বিপরীতে এসব ছিল বেশ বেমানান।

ভূ-কম্পন আতঙ্ক, শৈত্যপ্রবাহে রেকর্ড মৃত্যু
গত ৬২ বছরের মধ্যে তীব্র মাত্রার ভূমিকম্পে জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়েছিল এ বছরই। আর বছরের একেবার শেষে শীতের তীব্রতা দেশের উত্তরের জেলাগুলোর জনজীবন প্রায় স্থবির কে এনেছে। চলমান শৈত্য প্রবাহ ও শীতজনিত রোগে দেশের নানাস্থানে প্রায় ৭০ জনের মৃত্যু ঘটে যা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সর্বোচ্চ। এসব মিলে ২০১১কে আমাদের দীর্ঘদিন মনে থাকার কথা!
দেশের বাইরের বড় ঘটনা
আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও এবছর ঘটেছে উল্যেখযোগ্য অনেক কিছু। অ্যাবোটাবাদে মার্কিন নেভি সিল নামের দুর্ধর্ষ কমান্ডো বাহিনী কর্তৃক বিন লাদেন হত্যা, লিবীয় নেতা কর্নেল গাদ্দাফির মৃত্যু, জাপানের ফুকুশিমায় ভয়াবহ ৮.৮ মাত্রার ভুমিকম্প ও সুনামি, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়া, সিরিয়ায় সরকার পতনের আন্দোলন, তাহরির স্কয়ারের আন্দোলনের সফল পরিণতিতে মিসরে হোসনি মোবারক যুগের অবসান- আরো কত কী!
এসব সাড়া জাগানো ঘটনার সঙ্গে ২০১১ তে আরও একটি প্রসঙ্গ বিশ্বসংবাদ মাধ্যম তথা বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছিল সুনামির মতই- তা হলো ভিন্ন ধারার সংবাদসূত্র উইকিলিক্স। দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের মার্কিন দূতাবাস এবং গোয়েন্দাদের পাঠানো হাজার হাজার গোপন রিপোর্ট প্রকাশ করে উইকিলিক্সের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ ব্রেকিং আর স্কুপ সংবাদপ্রেমী মিডিয়াকর্মী ও সাধারণ মানুষের কাছে রূপকথার রাজকুমারে পরিণত হন। উইকিলিক্স ফাঁস করা মার্কিন গোয়েন্দা তথ্যে বাংলাদেশ সম্পর্কিত কয়েক হাজার গোপন তথ্যও প্রকাশ পায়। এ ঘটনা সামাল দিতে ওবামা প্রশাসনকে কঠিন বেগ পেতে হয়েছে তা অনস্বীকার্য।
অপরদিকে উইকিলিক্স কাণ্ডের অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকেও পড়তে হয় মামলা ও কারাবরণের তিক্ত অভিজ্ঞার মুখে। যদিও জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ বৃটেনে কারাবন্দি হয়েছিলেন ভিন্নধারার একটি মামলায় তবে চক্ষুষ্মান ব্যক্তিমাত্রই বুঝে নিয়েছেন যে এর সঙ্গে মার্কিন তথ্য ফাঁস করে দেওয়ার ঘটনাই সম্পর্কযুক্ত। শেষ পর্যন্ত মামলা মুক্ত হয়ে বন্দিদশা থেকে অ্যসাঞ্জ মুক্ত হন। অ্যাসাঞ্জের বন্দি থাকাকালে দুনিয়াজুড়ে তার সমর্থনে মানুষের ব্যাপক শুভাসীষ আর কর্মকাণ্ডও এক ইতিহাসই বটে। এসময় তাকে নোবেল দেওয়ার দাবিও উঠেছিল।
বছরের শেষদিকে যুক্তরাষ্ট্র নির্মিত মনু্ষ্যবিহীন অত্যাধুনিক স্টিল্থ প্রযুক্তির যুদ্ধবিমান ড্রোন ইরানের মাটিতে নামিয়ে আনার ঘটনা ইরান-মার্কিন সম্পর্কের টানাপোড়েনে নয়া মাত্রা যোগ করে। একইসঙ্গে ‘রূপকথা’র ড্রোন বিমান নিয়ন্ত্রণের প্রযুক্তি নিজেদের করায়ত্ব করার ইরানি দাবিও বিশ্বজুড়ে সমরবিদদের নতুন ভাবনার খোরাক এনে দেয়।
তাদের কথা মনে পড়বে খুব!
abdur২০১১ তে আমরা হারিয়েছি আমাদের প্রিয় পপসম্রাট মুক্তিযোদ্ধা আযম খান, বিএনপি মহাসচিব মুক্তিযোদ্ধা খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন, চিত্রশিল্পী মকবুল ফিদা হুসেন, উপমহাদেশের প্রখ্যাত গজল শিল্পী জগজিৎ সিং, মানুষ মানুষের জন্য খ্যাত অসমী গায়ক ভূপেন হাজারিকা, অ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবস, জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী এবং ২০১১ এর শেষ প্রান্তে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুর রাজ্জাককে।
২০১১ জুড়ে ছোটখাটো নানান অর্জনের সুখভোগের পাশাপাশি হারানোর বেদনাটা এবার বোধহয় বেশিই ছিল। বলা যায় ওইসব হারানোর দুঃখের পাশাপাশি জায়গা করে নেবে নানা অর্জনের সুখও। আগামী বছর ২০১২তেও আমরা সেইসব গুণী আর প্রিয়জনদের স্মরণ করবো বেদনায়, শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায়!
বাংলাদেশ সময়: ১৮৫০ ঘণ্টা, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১১

















বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বিলুপ্ত-প্রায় ঘানি শিল্প

বিলুপ্ত-প্রায় ঘানি শিল্প


আসাদুল হক খোকন, নিউজরুম এডিটর
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
ঢাকা: আজ থেকে প্রায় ২৩০০ বছর আগের কথা। মৌর্য শাসনামলে দীর্ঘদিনের টানা খরার ফলে দেখা দেয় তীব্র দুর্ভিক্ষ। দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় মৌর্য স্বরাট জনগণের মাঝে চালু করেন বিনামূলে খাদ্যশস্য বিতরণ ব্যবস্থা। এ খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে ছিল ধান এবং তেলবীজ- বিশেষ করে তিল ও সরিষা।

তেলবীজ থেকে তেল উৎপাদনের জন্য তখনও কোন প্রযুক্তিগত যন্ত্র বা মেশিন তৈরি হয়নি। তাই খাবারে স্বাদ আনতে বা প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে প্রতিদিনের রান্নায় ভোজ্য তেলের চাহিদা পূরণ করা হতো বিশেষ পদ্ধতিতে হাতে তৈরি তেল দিয়েই।

এ কাজের জন্য সবার বাড়িতেই সপ্তাহে কমপক্ষে একদিন মহিলাদের সময় কাটত মহা ব্যস্ততায়। অর্থাৎ গৃহকাজের সময়ের বড় একটি অংশ ব্যয় হতো প্রতিদিনের রান্নার তেল তৈরির পেছনেই।

মৌর্য শাসনামলের সেই দুর্ভিক্ষ আর মৌর্য স্বরাটের বিনামূল্যে ধান ও তেলবীজ বিতরণের ঘটনা তাদের পুরনো পদ্ধতিতে কিছুটা পরিবর্তন এনে দেয়। তখন থেকেই মূলত: তেল উৎপাদনে ঘানি একটি ক্ষুদ্র শিল্প হিসেবে সমাজে স্থান করে নেয়।

পরবর্তীতে ঘাঁনিকে কেন্দ্র করে দেশের বেশ কিছু গ্রামগঞ্জে গড়ে ওঠে  তেল ব্যবসা। তেল উৎপাদনকে কোন কোন পরিবার স্থায়ী পেশা হিসেবেও গ্রহণ করে নেয়।

কিন্তু তেল উৎপাদনকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করায় এসব পরিবারকে পরবর্তীতে সমাজ মর্যাদার কোন আসন দেয়নি। বরং অবজ্ঞা করে তাদের পরিবারকে ‘তেলি বা  তৈলিক’ নামে ডাকা হতো।

কালের বিবর্তনে তেলি বা তৈলি নামটির বদলে তেল উৎপাদন এবং বিক্রির উপর নির্ভরশীল এসব পরিবারগুলো একসময় ‘কলু’ নামে পরিচিতি পায়।

বিশেষজ্ঞদের মতে- হিন্দি শব্দ ‘কলহু’ থেকে ‘কলু’ শব্দটির উৎপত্তি। তবে শব্দের উৎপত্তি যেভাবেই হোক, কলহু বা কলু বলতে আমরা তেল উৎপাদক ও বিক্রির সঙ্গে সরাসরি জড়িত পরিবারগুলোকেই জানি।

শুরুতে নিরুপায় বা অপেক্ষাকৃত হতদরিদ্র হিন্দু পারিবারগুলো তেল উৎপাদন ও বিক্রিকে  পেশা হিসেবে গ্রহণ করে। পরে একই ধরণের কিছু সংখ্যক মুসলিম পরিবারও এ পেশায় আসেন।

প্রথমদিকে এ কাজে পরিবারের প্রায় সবাইকে দিনমান ব্যস্ত থাকতে হতো। তিল বা শরিষা সংগ্রহ, শুকানো, সেদ্ধ করা, ঢেঁকিতে মাড়াই করা এবং তা থেকে হাতে চেপে তেল তৈরি করা প্রতিটি ধাপেই ব্যয় হতো যথেষ্ট শ্রম ও সময়।

পরে তেলবীজ মাড়াই করার হস্তচালিত যন্ত্র ‘ঘানি’ আবিষ্কার হলে তাদের কষ্ট ও সময় অনেকটাই সহজসাধ্য হয়।

‘ঘানি’ বা ওয়েল ক্রাশার মেশিন মূলত: একটি গর্তযুক্ত কাঠের গুঁড়ি ও তার ভেতর ঘূর্ণায়মান একটি মজবুত কাঠের টিপুন বা দন্ড। কাঠের গর্তযুক্ত গুঁড়ির একাংশ মাটিতে শক্ত করে পুঁতে দেওয়া হয় এবং অন্য অংশটি থাকে মাটির ওপরে।

তেল মাড়াইয়ের জন্য কাঠের গুঁড়ির গর্তে তেলবীজ রেখে কাঠের দন্ডটিকে চারপাশে চক্রাকারে ঘোরানো হয়। অপেক্ষাকৃত ভারী ওজনের টিপুনটিকে ঘোরানোর জন্য ব্যবহৃত হয় একজোড়া শক্তসমর্থ বলদ।

বলদের যাতে ছুটে পালাতে না পারে তার জন্য তাদের চোখে পরিয়ে দেওয়া হয় মোটা কাপড়ের ঠুলি। দিনমান জোয়াল কাঁধে নিয়ে ভারী ওজনের টিপুনটিকে চারপাশে ঘোরানোই তাদের কাজ।

বহুল প্রচলিত ‘কলুর বলদ’ প্রবাদটি মূলত: এভাবেই এসেছে।

ঘানি থেকে তেলবীজ পিষে তেল বের করার জন্য কাঠের পাত্রের গায়ে রাখা হয় একটি ত্রিভূজ আকৃতির নালাপথ। নালা থেকে চোয়ানো তেল আহরণ করা হয় একটি পাত্রে। পরে আহরিত তেল ছেঁকে নিয়ে বিক্রয় উপযোগী করা হয়। ভোজ্যতেল উৎপাদনের সনাতন পদ্ধতির এই হস্তচালিত বা ম্যানুয়াল মেশিনের নামই ঘানি।

অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে, এক সময় দেশের যাবতীয় পরিবারের নিত্যদিনের ভোজ্য উৎপাদনের একমাত্র উপায়ই ছিল এই ঘানি। সয়াবিন বা পামওয়েল জাতীয় তেল আমদানির আগে তাই সর্ষে বা তিলের তেলই ছিল আমাদের রান্নার একমাত্র ভরসা। আর আস্থা ছিলো ঘানিভাঙা নির্ভেজাল ও খাঁটি  তেলে।

ঘানিভাঙা তেল বিক্রির পদ্ধতিও ছিলো ভিন্ন। অল্প বিস্তর নিজেদের বাড়িতে বসে আশপাশের ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করা হলেও বাকি তেলের বেশিরভাগই বিক্রি করতে হতো ফেরি করে। তেল বিক্রিতে কলুরা যাতে না ঠকে সে জন্য এ ফেরি করার কাজে পাঠাতো পরিবারের সব চেয়ে চতুর পুরুষটিকে।

পাকা বাঁশের তৈরি বাঁক বা ভাঁড়ের এক পাশে হাঁড়িতে করে তেল এবং অন্য পাশে রবি শস্য নিতো তেল বিক্রির বিনিময় মূল্য হিসেবে। সারাদিন গ্রাম থেকে গ্রামে এ-বাড়ি ও-বাড়ি হেঁকে-ডেকে তেল বিক্রি করে নগদ টাকা আর গৃহস্থ বাড়ি থেকে পাওয়া মৌসুমী রবি শস্য নিয়ে বাড়ি ফিরতে হতো সন্ধ্যায়।

সমাজে কলুদের সম্মান না থাকলেও খাঁটি তেলের সুনাম ছিলো ষোল আনা। ‘সর্ষে তেলে ভেজাল দিতে আমায় কেউ শেখায়নি’ ভূপেন হাজারিকার একটি গানের কথা এমনটি হলেও ভেজাল কিছুটা তখনও ছিলো।

কখনো কখনো কলুরা বেশি মুনাফা লাভের আশায় ঘানিতে সরিষা, তিল, তিশি,  ড়েঢ়ি বা ভেন্না জাতীয় তেলবীজ মিশিয়ে দিতো। কিন্তু ঘ্রাণ শুকেই কোন কোন ভোজনরসিক ক্রেতা ধরে ফেলতো কলুদের চালাকি।

সর্বোপরি বাঙালির প্রাত্যহিক খাদ্য তালিকায় ভোজ্য তেল বিশেষ করে সরিষা তেল ছিলো একটি অনিবার্য উপকরণ। এ কারণে দেশের প্রায় প্রতিটি গ্রামেই ঘানিকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল পরিবারভিত্তিক একটি ব্যবসা। ঘানি পরিচিতি লাভ করেছিল একটি শিল্প হিসেবেও।

খাঁটি ভোজ্য তেল উৎপাদনের একমাত্র উৎস হিসেবে ঘানির নাম গ্রাম বাংলার মানুষের কাছে বহূল পরিচিত। কালের আবর্তনে আর উন্নত প্রযুক্তির কল্যাণে সনাতনী মেশিন ঘানির স্থান দখল করেছে আধুনিক স্বয়ংক্রিয় তেলবীজ মাড়াই মেশিন।

মূহুর্তেই উৎপাদিত হচ্ছে বিপুল পারিমাণ ভোজ্য তেল। পূর্বে যেখানে  এক লিটার তেল তৈরিতে সময় ব্যয় হতো একদিন বা কয়েক ঘন্টা। বর্তমানে সেখানে ব্যয় হয় মাত্র কয়েক মিনিট। নেই বাড়তি শ্রম ও অযাচিত ভাবনার ঝুঁকিও।

বর্তমান প্রযুক্তির কল্যাণে তেল উৎপাদনের ঐতিহ্যবাহী ঘানির নাম ভুলতে বসেছে আমাদের নতুন প্রজন্ম। তেল উৎপাদনকে যারা পারিবারিক পেশা হিসেবে নিয়েছিলো, নেই সেই  কলু সম্প্রদায়। এখন ‘বিএসটিআই’ এর তত্ত্বাবধানে চলছে সকল ভোগ্য পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ।

কিন্তু এতোসবের পরও আমাদের দূর হয়নি দুশ্চিন্তা, সন্দেহ! এই সন্দেহটি হলো- প্রতিদিনের রান্নায় যে তেল ব্যবহার করা হচ্ছে তা  খাঁটি তো? খাঁটি নামে বিজ্ঞাপিত ব্রান্ডের তেলে ভেজাল নেই তো?

বাংলাদেশ সময়: ১৬৫৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৪, ২০১১
















বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

গ্রাফিক আর্টসে ‘অনুপ্রেরণা’ শীর্ষক শিল্পকর্ম প্রদর্শনী

গ্রাফিক আর্টসে ‘অনুপ্রেরণা’ শীর্ষক শিল্পকর্ম প্রদর্শনী


আসাদুল হক খোকন, নিউজরুম এডিটর
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
ঢাকা: আর্ন্তজাতিক মার্তৃভাষা দিবস উপলক্ষে ঢাকার মোহাম্মদপুরে দেশের একমাত্র মুদ্রণ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গ্রাফিক আর্টস ইনস্টিটিউট অডিটোরিয়ামে  শুরু হয়েছে ‘অনুপ্রেরণা’ শীর্ষক ৩ দিনব্যাপী শিল্পকর্ম প্রদর্শনী।
গ্রাফিক আর্টস ইনস্টিটিউটের প্রাক্তন ও ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ্স (ইউডা) এর চারুকলা বিভাগে অধ্যয়নরত ১৪ জন তরুণ শিক্ষার্থীর আঁকা শিল্পকর্ম নিয়ে প্রদর্শনীটি শুরু হয়েছে মঙ্গলবার ২১ ফেব্রয়ারি থেকে।

ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ্স (ইউডা) এর চারুকলা বিভাগের চেয়ারম্যান শিল্পী শাহজাহান আহমেদ বিকাশ মঙ্গলবার বিকেলে প্রদর্শনীটির  আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন ।

উদ্বোধনকালে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন- গ্রাফিক আর্টস-এর অধ্যক্ষ শেখ মফিজুর রহমান, শিল্পী আলাউদ্দিন আহমেদ, প্রফেসর চারুকলা বিভাগ, ইউডা এবং মোল্লা মো. গোলাম মোস্তফা, বিভাগীয় প্রধান, গ্রাফিক ডিজাইন টেকনোলাজি, গ্রাফিক আর্টস।

ইন্সপাইরেশন বা অনুপ্রেরণা শীর্ষক এ প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে ৬০টিরও বেশি চিত্রকর্ম। এসব চিত্রকর্ম তৈরিতে ১৪ জন তরুণ শিল্পী জলরঙসহ বিভিন্ন মাধ্যমকে ব্যবহার করেছেন।
অংশগ্রহণকারী শিল্পীরা তাদের শিক্ষাকার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন শিল্পকর্ম ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকন, পর্যবেক্ষণ ও উপলব্ধি করে এসব শিল্পকর্মে তাদের  অনুভূতির শৈল্পিক প্রকাশ ফুটিয়ে তুলেছেন।

প্রতিদিন বিকেল ৪টা থেকে চলবে রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। প্রদর্শনীটি আগামী ২৩ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার পযর্ন্ত চলবে।

বাংলাদেশ সময়: ২১০৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১২
















বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

শনিবার, ১০ মার্চ, ২০১২

টাংগাইলের ঐতিহ্য পোড়াবাড়ির চমচম





টাংগাইলের ঐতিহ্য পোড়াবাড়ির চমচম
আসাদুল হক খোকন, নিউজরুম এডিটর
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বাঙালীর যে কোন শুভ কাজ বা সংবাদে মিস্টির ব্যবহার অনেক পুরনো ঐতিহ্য বিয়ে-স্বাদী, পরীক্ষা পাসের খবর, সন্তান জন্ম গ্রহণ, কোন কিছুর শুভ সূচনা বা উদ্বোধনী অনুষ্ঠান, অতিথি আপ্যায়ন মিলাদ মাহফিলের মতো অনুষ্ঠানের খাদ্য তালিকার অগ্রভাগে থাকে মিস্টি    

চমচম, সন্দেশ, রসগোল্লা, মতিচূড়, কালোজাম, রঁসমালাই, পানতোয়া, বালিশ, আমিত্তি, জিলেপী, রাজভোগ, ক্ষীরমোহন, ভূবনেশ্বর, লাড্ডু, কাঁচাগোল্লা এমন সব বাহারি নামের মিস্টি পাওয়া যায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে
 
শুধু নামেই নয়, আকৃতি আর স্বাদ-গন্ধেও রয়েছে এদের ভিন্নতা অনেকের মতে মিষ্টির রাজা পোড়াবাড়ির চমচমের নাম শুনেই নাকি জিভে জল আসে! স্বাদের দিক দিয়ে তাই পোড়াবাড়ির চমচমের সুখ্যাতি সর্বজন বিদিত!

টাঙ্গাইল জেলার পোড়াবাড়ি নামক স্থানটি এই সুস্বাদু মিস্টির জন্মস্থান বলে এটি  পোড়াবড়ির চমচম নামেই স্বমহিমায় মহিমান্বিত

নাম তার চমচম
দেখতে অনেকটা লম্বাটে আকৃতির মিস্টির নাম চমচম হালকা আঁচে পোড় খাওয়া এই মিস্টির রঙ গাঢ় বাদামি বাহিরটা একটু শক্ত হলেও এর ভেতরটা কিন্তু একদম রসে ভরপুর একেবারে মাত্রামতো মিস্টি, ঘন রস আর টাটকা ছানার গন্ধ মাখা পোড়াবাড়ির এই মিস্টির স্বাদ সত্যি অতুলনীয় কেউ কেউ তাই মজা করে বলেন- এটি এমন জিনিস, যে না খাবে সেই পস্তাবে!

স্বাতন্ত্রেও এর জুড়ি  মেলে না এর সুনাম রয়েছে বাংলা, বিহার ছাড়িয়ে সারা ভারতবর্ষজুড়ে লালচে রঙের এই সুস্বাদু চমচমের উপরিভাগে চিনির গুঁড়ো আর মাওয়া জড়ানো থাকে এর ভেতরের অংশ বিশেষ কায়দায় করা হয় ফাঁপা রসাল নরম
 
দশরথ গৌড়ের চমচম
পোড়াবাড়ির চমচম সম্পর্কে ইতিহাস ঘেঁটে যতটা যানা যায়- ব্রিটিশ শাসন আমলে দশরথ গৌড় নামের এক ব্যক্তি টাঙ্গাইল এর যমুনা নদীর তীরবর্তী পোড়াবাড়িতে আসেন আসাম থেকে এসে দশরথ গৌড় যমুনার সুস্বাদু মৃদু পানি এখানকার গরুর খাঁটি দুধ দিয়ে প্রথম তৈরি করেন এক ধরনের বিশেষ মিস্টি লম্বাটে আকৃতির মিস্টির নাম দেন তিনি চমচম তার তৈরি চমচম এলাকার লোকজন পছন্দ করতে শুরু করে পরে সে এখানে রীতিমত মিস্টির পশরা সাজিয়ে বসেন

টাঙ্গাইল জেলা সদর থেকে মাত্র মাইল পশ্চিমে একদা ঘাট ছিল, এর নাম তালান-ঘাট সেখানে ভিড়তো সওদাগরী নৌকা, জাহাজ লঞ্চ দেশী-বিদেশী ব্যবসায়ীদের পদচারনায় সে সময় পোড়াবাড়ি পরিণত হয় এক ব্যস্ত ব্যবসা কেন্দ্রে তখন দশরথ গৌড়ের চমচমের ব্যবসাও হয়ে ওঠে জমজমাট ধীরে ধীরে দেশ বিদেশে দশরথ গৌড়ের তৈরি চমচম প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে পোড়বাড়ির চমচম নামে  

টাঙ্গাইল শহরের পাঁচ আনী বাজারের পুরাতন মিষ্টি ব্যবসায়ীদের মতে উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকেই পোড়াবাড়িতে প্রথম চমচম  তৈরি শুরু হয় দশরথ গৌড়ই এর স্রষ্টা সে সময় তার সাথে মিষ্টি  তৈরিতে সাহায্যকারী হিসেবে রাজারাম গৌড়, মদন গৌড়, শিব শংকর, নারায়ন বাবু প্রমুখের নাম শোনা যায়

চমচমের ব্যবসায়িক অবস্থা
সে সময় যমুনা আর ধলেশ্বরী ছিল স্রোতস্বিনী তখন লঞ্চ-স্টিমারযোগে সহজেই পোড়াবাড়ির চমচম পৌঁছে যেত ভারতবর্ষের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সপ্তাহে ১৫ থেকে ২০ মন চমচম তৈরি হতো পোড়াবাড়িতেই উত্তরোত্তর সাফল্য চাহিদার কারণে তখন পোড়াবাড়িতে গড়ে ওঠে প্রায় ৪০ থেকে ৫০টি চমচম তৈরির কারখানা এসব কারখানার সাথে জড়িত ছিল তিন শতাধিক পরিবারের জীবন জীবিকা

কালের আবর্তে যমুনার শাখানদী ধলেশ্বরীর বুকে জেগে উঠে অসংখ্য চর এতে বন্ধ হয়ে যায় পোড়াবাড়ির নৌপথের ব্যবসা-বাণিজ্য ক্রমে ক্রমে জনবহুল পোড়াবাড়ি পরিণত হয় পোড়ো-বাড়ি বা জনশূন্য বাড়িতে
 
অনন্য স্বাদের পোড়াবাড়ির চমচম দেশ বিদেশে এখনও তার ঐহিত্য ধরে রাখলেও শিল্পকে কেন্দ্র করে যারা জীবিকা নির্বাহ করতো, তারা হয়ে পড়েছে বেকার বেঁচে থাকার তাগিদে অনেকেই বেছে নিয়েছে ভিন্ন পেশা
 
এসব কারণে; চমচমের ব্যবসা না থাকায় পোড়াবাড়ি বাজারের অবস্থা খুবই করুণ বাজারের থেকে ৫টি ভাঙাচোরা চমচমের দোকান শুধুমাত্র পুরনো ঐতিহ্যের স্মৃতি বহন করে চলেছে মাত্র
 
চমচম তৈরির সাথে সম্পৃক্তরা জানান- কিছু খাঁটি মানের চমচম টাংগাইলের পাঁচআনী বাজারের মিস্টির দোকানে পাওয়া গেলেও বাকিরা মূলতঃ পোড়াবাড়ির নাম ভাঙিয়ে বিক্রি করে খারাপ মানের চমচম এসব দোকানি ব্যবসায়ী টাংগাইলসহ রাজধানী ঢাকাতেও দেদারসে ঠকাচ্ছে ক্রেতাদের এতে নস্ট হচ্ছে পোড়াবাড়ির চমচমের ঐতিহ্য দামেও রয়েছে বিস্তর ফারাক ঢাকায় প্রতি কেজি চমচম ২০০টাকা থেকে শুরু করে বিক্রি হয় ৩৫০ টাকা পর্যন্ত কিন্তু টাংগাইলে পোড়াবাড়ির চমচম বিক্রি হচ্ছে ১৮০ টাকায়

আসল চমচমের ৎস
দামে যাই হোক, যারা এই চমচম রসিকরা ঠিকই ধরে ফেলেন ভেজাল আর জানেন খাঁটি মানের চমচমের আসল ঠিকানাও কারণে অনেক ক্রেতাই ঢাকার মিস্টির দোকানগুলোয় এখানে টাংগাইলের পোড়াবাড়ির চমচম পাওয়া যায় বিজ্ঞাপন লেখা থাকলেও ভেতরে ঢোকেন না তারা তাদের পছন্দের চমচম আনেন স্বয়ং টাংগাইল গিয়ে অথবা কাউকে পাঠিয়ে

পোড়াবাড়ি বাজারের আশে পাশের কয়েকটি বাড়িতে এখনও তৈরি হয় খাঁটি মানসম্পন্ন চমচম এসব চমচম রাজধানী ঢাকা ছাড়াও বিভিন্ন শহরে সরবরাহ হয় কিছু খাঁটি মানের চমচম পাওয়া যায় টাংগাইলের কালিবাড়ি বাজারের মিস্টির দোকানগুলোতে খোকা ঘোষের জয়কালী মিস্টান্ন ভান্ডার এদের মধ্যে অন্যতম

পোড়াবড়ির চমচম তৈরির অভিজ্ঞ কারিগরদের মতে- চমচমের গুণগত মান আর স্বাদ মূলত পানি এবং দুধের উপরই নির্ভরশীল এখানে এই দুটি মৌল শর্ত পূরণ হয় বলে মিষ্টি স্বাদে, গন্ধে, তৃপ্তিতে অতুলনীয় তাছাড়া চমচমের বিশেষ বৈশিষ্ট হলো- ভেতরেটা ফাঁপা অন্য সব মিস্টিও মতো ভরাট নয় আর চমচমের গায়ে জড়ানো মাওয়া হতে হবে একদম খাঁটি এসবে কোন ছাড় দেয়া হলেই তার স্বাদ হয়ে যাবে ভিন্ন

সর্বপরি পোড়াবাড়ির চমচম তৈরিতে রয়েছে বিশেষ টেকনিক বা কলাকৌশল যা একমাত্র অঞ্চলের গুটি কয়েক পরিবারের লোকরাই ভালোভাবে রপ্ত করেছেন ধরে রেখেছেন এখনো টাংগাইলের প্রাচীন ঐতিহ্য

বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মিষ্টি ব্যবসায়ীরা পোড়াবাড়ির প্রস্তুতপ্রণালী ব্যবহার করে চমচম বানিয়েছে, কিন্তু এই মানের চমচম তৈরি করতে পারেননি
এজন্যেই পোড়াবাড়ির চমচমের বিকল্প হয় না