ভ্যালেন্টাইন ডে : প্রথা, মিথ ও কুসংস্কার
আসাদুল হক খোকন
সত্যিকার ভ্যালেন্টাইন’স ডের
ইতিহাস সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞের ধারণা রোমান
সেন্ট ভ্যালেন্টাইন খ্রিস্টধর্ম ত্যাগ না করায় তাকে নির্মমভাবে হত্যার ঘটনা
থেকেই এর উৎপত্তি। ২৬৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি তার আত্মত্যাগের ওই
দিনটি ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে পালিত হয়।
কিছু বিশেষজ্ঞ অবশ্য বলে
থাকেন, সেন্ট ভ্যালেন্টাইন কারাগারে বন্দি থাকার সময় কারারীর মেয়েকে তার
স্বারিত একটি চিঠি দেন, যাতে লেখা ছিল ‘লাভ ফ্রম ইওর ভ্যালেন্টাইন’।
ভালোবাসার এমন স্মৃতিকে জড়িয়েই পরবর্তী সময়ে ভ্যালেন্টাইন ডে’র প্রচলন হয়।
অপর
একটি ধারণা, রোমান সম্রাট কডিয়াসের সময় সেন্ট ভ্যালেন্টাইন গির্জার
ধর্মযাজক ছিলেন। কডিয়াস তার সাথে মতবিরোধের জন্য প্রথমে তাকে কারাবন্দি
করেন। পরে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেন।
৪৯৬ খ্রিস্টাব্দে পোপ
জেলাসিয়াস সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের সম্মানে ১৪ ফেব্রুয়ারি দিনটি নির্ধারিত
করেন এবং পরবর্তীকালে তার নামানুসারেই পালিত হতে থাকে এই অনুষ্ঠান।
ভ্যালেন্টাইন’স
ডে উদযাপন শুরু হয় রোমান সাম্রাজ্যের সময় থেকে। প্রাচীন রোমে ১৪
ফেব্রুয়ারি ছিল রোমান দেবদেবীদের রানী জুনোর সম্মানে পবিত্র দিন। রোমানরা
তাকে নারী ও বিবাহের দেবী বলে বিশ্বাস করত। দিনটি অনুসরণ করে পরের দিন ১৫
ফেব্রুয়ারি পালিত হতো লুপারকেলিয়া উৎসবের বিশেষ ভোজ।
সে সময় তরুণ
এবং তরুণীদের জীবনযাপন ব্যবস্থা ছিল সম্পূর্ণ পৃথক। কিন্তু তরুণদের জন্য
‘দৃষ্টি আকর্ষণ’ নামে একটি ভিন্নধর্মী প্রথা ছিল ‘লটারি’। লুপারকেলিয়া
উৎসবের সন্ধ্যায় কাগজের টুকরায় তরুণীদের নাম লিখে একটি পাত্রে জমা করা হত।
সেখান থেকে এক একজন তরুণ একটি করে কাগজের টুকরা তুলত এবং কাগজের টুকরায় যে
তরুণীর নাম লেখা থাকত ওই উৎসবের সময় পর্যন্ত সে তাকে তার সঙ্গী হিসেবে
পেত। পরে কখনো কখনো ওই দুজনের জুটি পুরো বছর ধরে টিকে থাকত এবং প্রায়শ তারা
একে অপরের প্রেমে পড়ত এবং সব শেষে তা বিয়ে পর্যন্ত গড়াত।
সম্রাট
কডিয়াসের শাসনামলে রোম কয়েকটি জনবিরোধী এবং রক্তয়ী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল।
হিংস্র প্রকৃতির কডিয়াস সে সময় তার সেনাবাহিনীতে যথেষ্ট সংখ্যক সৈন্য ভর্তি
না হওয়া নিয়ে খুব কঠিন সময় পার করছিলেন। রোমান পুরুষদের তাদের পরিবার ও
ভালোবাসা ত্যাগ করে যুদ্ধে না যাওয়াকেই এর প্রধান কারণ হিসেবে দায়ী
করছিলেন তিনি। ফলে কডিয়াস সমগ্র রোমে সব ধরনের বিয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি
করেন। সে সময় সেন্ট ভ্যালেন্টাইন রোমের একজন ধর্মযাজক ছিলেন। তিনি এবং
সেন্ট ম্যারিয়াস খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী তরুণ-তরুণীদের গোপনে বিয়ে দিতেন এবং
বিবাহিত যুগলদের সহযোগিতা দিতেন। এ কারণে রোমের ম্যাজিস্ট্রেট তাকে
গ্রেফতার করে কারাবন্দি করেন।
ভ্যালেন্টাইন বন্দি থাকা অবস্থায়
অনেক তরুণ তাকে দেখতে যেত এবং কারাকরে জানালা দিয়ে তার উদ্দেশ্যে লেখা
চিরকুট ও ফুল দিয়ে তাদের ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করত। হাত নেড়ে তাকে
জানাত যে, তারা ‘যুদ্ধ নয়, ভালোবাসায় বিশ্বাসী’। এদের মধ্যে একজন ছিল
কারারীর মেয়ে। তার বাবা তাকে ভ্যালেন্টাইনের সাথে সাক্ষাৎ করতে এবং তার
সাথে কথা বলতে সুযোগ করে দিত। মেয়েটি তাকে তার প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা,
কডিয়াসের নির্দেশ অমান্য করে তরুণ-তরুণীদের গোপনে বিয়ে দেওয়া এবং
ভালোবাসায় তার সমর্থনের কথা জানায়। এক সময় তারা এক অপরের বন্ধু হয়ে যায়।
ভ্যালেন্টাইনের শিরোচ্ছেদ করে হত্যার দিনে তিনি মেয়েটিকে তার বন্ধুত্ব এবং
ভালোবাসার প্রতি বিশ্বাস নিয়ে একটি চিরকুট লিখে রেখে যান। এতে তিনি
লিখেছিলেনম, ‘লাভ ফ্রম ইওর ভ্যালেন্টাইন’। বিচারকের নির্দেশ অনুসারে সে
দিনই তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের এই আত্মত্যাগের
দিনটি ছিল ২৬৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি।
সত্যিকার অর্থেই
প্রাচীন রোম ছিল নানা প্রথা ও কুসংস্কারের অন্ধকারে নিমজ্জিত একটি দেশ। এসব
প্রথার মধ্যে লুপারকেলিয়া ছিল একটি। এটি অনুষ্ঠিত হত ফেব্রুয়ারির ১৫
তারিখ। ৪৯৬ খ্রিস্টাব্দে পোপ জেলাসিয়াস সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের সম্মানে
লুপারকেলিয়া অনুষ্ঠানের দিন ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখের পরিবর্তে ১৪
ফেব্রুয়ারি নির্ধারিত করেন। পরে এটি সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের নামানুসারে
‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ নামে দ্রুত পরিচিতি লাভ করে।
কালের ধারাবাহিকতায়
১৪ ফেব্রুয়ারি প্রেমিক-প্রেমিকাদের কাছে ভ্যালেন্টাইন ডে এবং সেন্ট
ভ্যালেন্টাইন এর কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। নানা সামাজিক
অনুষ্ঠানের পাশাপাশি বাহারি ফুল, কবিতা ও ছোটখাট উপহার বিনিময়ের মধ্য দিয়ে
সারা বিশ্বে দিনটি ব্যপকভাবে উদ্যাপিত হয়।
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের
মিস্ এস্থার হাওল্যান্ড প্রথম ভালেন্টাইন কার্ড পাঠানোর প্রচলন করেন। ১৮০০
সাল থেকে দিনটি বাণিজ্যিকভাবে উদ্যাপন শুরু হলেও বর্তমানে এটি বিশ্বের
অনেক দেশেই বাণিজ্যিকভাবে উদ্যাপিত হয়। বিশেষ করে ১৪ ফেব্র“য়ারিকে ঘিরে
লাভল্যান্ড ও কলারাডো সবচে বেশি ব্যবসায়িকভাবে লাভবান হয়।
আজ থেকে
শতবর্ষ আগে ব্রিটেনে ছোট শিশুরা দল বেঁধে বাড়ি বাড়ি গান গেয়ে দিনটি
উদ্যাপন করত। ওয়েলেসে কাঠের তৈরি চামচের ওপর হৃৎপি-, তালা, শেকল প্রভৃতির
নকশা খোদাই করে এ দিনে উপহার দেয়া হতো। এর মানে ছিল ‘ইউ আনলক মাই হার্ট’।
কোথাও আবার এ দিনে তরুণীরা রোদে একটি বাটিতে পরিষ্কার পানি রেখে তার ওপর
চেয়ে থাকত। ধারণা করা হতো, যার ছবি ওই পানিতে ভেসে উঠবে সে-ই হবে তার
কাক্সিক্ষত ভ্যালেন্টাইন। কোথাও ফেব্র“য়ারির ১৪ তারিখে তরুণ-তরুণীরা তাদের
জামার হাতায় কাক্সিক্ষত ভালোবাসার মানুষটির নাম লিখে সপ্তাহজুড়ে ঘুরে
বেড়াত। তারা ধরেই নিতো, এর ফলে সহজেই কাছে পাবে তার ভালোবাসার মানুষটিকে।
কোনো
কোনো দেশে ১৪ ফেব্রুয়ারিতে অবিবাহিত ছেলেরা মেয়েদের নতুন পোশাক উপহার
হিসেবে পাঠাত এবং মেয়েটি ওই পোশাক গ্রহণ করলে ধরে নেয়া হতো, মেয়েটি তাকে
বিয়ে করতে রাজি আছে। ওইসব দেশে কিছু লোকদের ভ্যালেন্টাইনের ওপর বিশ্বাস আরো
একধাপ এগিয়ে। তারা বিশ্বাস করত, ১৪ ফেব্রুয়ারিতে যদি কোনো মেয়ে তার মাথার
ওপর একটি ফিতা উড়ে যেতে দেখে তাহলে তার বিয়ে হবে কোনো নাবিকের সাথে, যদি
সে একটি চড়ুই পাখি দেখে তবে তার বিয়ে হবে একজন দরিদ্র লোকের সাথে, কিন্তু
সে হবে খুবই সুখী। আর যদি সে সোনালি রঙের মাছ দেখে তবে তার বিয়ে হবে একজন
প্রভাবশালী ধনাঢ্য লোকের সাথে।
পৃথিবীর অনেক দেশেই এমন সব হাজারো
প্রথা, কুসংস্কার ও মিথ জড়িয়ে আছে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের আত্মত্যাগের
কাহিনীকে ঘিরে। ভালোবাসা সব সময়ই সর্বজনীন। আর ভালোবাসার জন্য শুধু
ভ্যালেন্টাইন কেন, যুগে যুগে পৃথিবীর বহু দেশে অসংখ্য মানুষ অকাতরে জীবন
দিয়েছেন। কিন্তু ঘটা করে বছরে একবার নারী-পুরুষের ভালোবাসা প্রকাশের জন্য
শুধু ভ্যালেন্টাইন নামক অনুষ্ঠানকে বেছে নেওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত, এ প্রশ্ন
থেকেই যায়।
পরিবর্তিত সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ভালোবাসার শরীরেও
লেগেছে আধুনিক প্রযুক্তির স্পর্শ। ডাকঘর, চিঠি আর ডাকপিয়নের জন্য কারো
প্রতীক্ষায় প্রহর গুনতে হয় না। মুঠোফোন, এসএমএস আর ইন্টারনেট মুহূর্তেই
ভালোবাসার মানুষটিকে চোখের নাগালে নিয়ে আসতে সম। প্রযুক্তির কল্যাণে
ভ্যালেনটাইন ডেও পেয়েছে এখন নতুন মাত্রা। জয় হোক ভালোবাসার।
বাংলাদেশ সময় ১৪১৫, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১১
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম’র
প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র,
ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে
না।
|
|
|
|
|
|
|
|
|
ফিচার-এর সর্বশেষ ২৪ খবর
|
|
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন