টাংগাইলের ঐতিহ্য পোড়াবাড়ির চমচম
আসাদুল হক খোকন, নিউজরুম এডিটর
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বাঙালীর যে কোন শুভ কাজ বা সংবাদে মিস্টির ব্যবহার অনেক পুরনো ঐতিহ্য। বিয়ে-স্বাদী, পরীক্ষা পাসের খবর, সন্তান জন্ম গ্রহণ, কোন কিছুর শুভ সূচনা বা উদ্বোধনী অনুষ্ঠান, অতিথি আপ্যায়ন ও মিলাদ মাহফিলের মতো অনুষ্ঠানের খাদ্য তালিকার অগ্রভাগে থাকে মিস্টি।
চমচম, সন্দেশ, রসগোল্লা, মতিচূড়, কালোজাম, রঁসমালাই, পানতোয়া, বালিশ, আমিত্তি, জিলেপী, রাজভোগ, ক্ষীরমোহন, ভূবনেশ্বর, লাড্ডু, কাঁচাগোল্লা এমন সব বাহারি নামের মিস্টি পাওয়া যায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।
শুধু নামেই নয়, আকৃতি আর স্বাদ-গন্ধেও রয়েছে এদের ভিন্নতা। অনেকের মতে মিষ্টির রাজা পোড়াবাড়ির চমচমের নাম শুনেই নাকি জিভে জল আসে! স্বাদের দিক দিয়ে তাই পোড়াবাড়ির চমচমের সুখ্যাতি সর্বজন বিদিত!
টাঙ্গাইল জেলার পোড়াবাড়ি নামক স্থানটি এই সুস্বাদু মিস্টির জন্মস্থান বলে এটি পোড়াবড়ির চমচম নামেই স্বমহিমায় মহিমান্বিত।
নাম তার চমচম
দেখতে অনেকটা লম্বাটে আকৃতির মিস্টির নাম চমচম। হালকা আঁচে পোড় খাওয়া এই মিস্টির রঙ গাঢ় বাদামি। বাহিরটা একটু শক্ত হলেও এর ভেতরটা কিন্তু একদম রসে ভরপুর। একেবারে মাত্রামতো মিস্টি, ঘন রস আর টাটকা ছানার গন্ধ মাখা পোড়াবাড়ির এই মিস্টির স্বাদ সত্যি অতুলনীয়। কেউ কেউ তাই মজা করে বলেন- এটি এমন জিনিস, যে না খাবে সেই পস্তাবে!
স্বাতন্ত্রেও এর জুড়ি
মেলে না। এর সুনাম রয়েছে বাংলা, বিহার ছাড়িয়ে সারা ভারতবর্ষজুড়ে। লালচে রঙের এই সুস্বাদু চমচমের উপরিভাগে চিনির গুঁড়ো আর মাওয়া জড়ানো থাকে। এর ভেতরের অংশ বিশেষ কায়দায় করা হয় ফাঁপা ও রসাল নরম।
দশরথ গৌড়ের চমচম
পোড়াবাড়ির চমচম সম্পর্কে ইতিহাস ঘেঁটে যতটা যানা যায়- ব্রিটিশ শাসন আমলে দশরথ গৌড় নামের এক ব্যক্তি টাঙ্গাইল এর যমুনা নদীর তীরবর্তী পোড়াবাড়িতে আসেন। আসাম থেকে এসে দশরথ গৌড় যমুনার সুস্বাদু মৃদু পানি ও এখানকার গরুর খাঁটি দুধ দিয়ে প্রথম তৈরি করেন এক ধরনের বিশেষ মিস্টি। লম্বাটে আকৃতির এ মিস্টির নাম দেন তিনি চমচম। তার তৈরি চমচম এলাকার লোকজন পছন্দ করতে শুরু করে। পরে সে এখানে রীতিমত মিস্টির পশরা সাজিয়ে বসেন।
টাঙ্গাইল জেলা সদর থেকে মাত্র ৩ মাইল পশ্চিমে একদা ঘাট ছিল, এর নাম তালান-ঘাট। সেখানে ভিড়তো সওদাগরী নৌকা, জাহাজ ও লঞ্চ। দেশী-বিদেশী ব্যবসায়ীদের পদচারনায় সে সময় পোড়াবাড়ি পরিণত হয় এক ব্যস্ত ব্যবসা কেন্দ্রে। তখন দশরথ গৌড়ের চমচমের ব্যবসাও হয়ে ওঠে জমজমাট। ধীরে ধীরে দেশ বিদেশে দশরথ গৌড়ের তৈরি চমচম প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে পোড়বাড়ির চমচম নামে।
টাঙ্গাইল শহরের পাঁচ আনী বাজারের পুরাতন মিষ্টি ব্যবসায়ীদের মতে উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকেই পোড়াবাড়িতে প্রথম চমচম তৈরি শুরু হয়। দশরথ গৌড়ই এর স্রষ্টা। সে সময় তার সাথে মিষ্টি
তৈরিতে সাহায্যকারী হিসেবে রাজারাম গৌড়, মদন গৌড়, শিব শংকর, নারায়ন বাবু প্রমুখের নাম শোনা যায়।
চমচমের ব্যবসায়িক অবস্থা
সে সময় যমুনা আর ধলেশ্বরী ছিল স্রোতস্বিনী। তখন লঞ্চ-স্টিমারযোগে সহজেই পোড়াবাড়ির চমচম পৌঁছে যেত ভারতবর্ষের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। সপ্তাহে ১৫ থেকে ২০ মন চমচম তৈরি হতো পোড়াবাড়িতেই। উত্তরোত্তর সাফল্য ও চাহিদার কারণে তখন পোড়াবাড়িতে গড়ে ওঠে প্রায় ৪০ থেকে ৫০টি চমচম তৈরির কারখানা। এসব কারখানার সাথে জড়িত ছিল তিন শতাধিক পরিবারের জীবন ও জীবিকা।
কালের আবর্তে যমুনার শাখানদী ধলেশ্বরীর বুকে জেগে উঠে অসংখ্য চর। এতে বন্ধ হয়ে যায় পোড়াবাড়ির নৌপথের ব্যবসা-বাণিজ্য। ক্রমে ক্রমে জনবহুল পোড়াবাড়ি পরিণত হয় পোড়ো-বাড়ি বা জনশূন্য বাড়িতে।
অনন্য স্বাদের পোড়াবাড়ির চমচম দেশ বিদেশে এখনও তার ঐহিত্য ধরে রাখলেও এ শিল্পকে কেন্দ্র করে যারা জীবিকা নির্বাহ করতো, তারা হয়ে পড়েছে বেকার। বেঁচে থাকার তাগিদে অনেকেই বেছে নিয়েছে ভিন্ন পেশা।
এসব কারণে; চমচমের ব্যবসা না থাকায় পোড়াবাড়ি বাজারের অবস্থা খুবই করুণ। বাজারের ৪ থেকে ৫টি ভাঙাচোরা চমচমের দোকান শুধুমাত্র পুরনো ঐতিহ্যের স্মৃতি বহন করে চলেছে মাত্র।
চমচম তৈরির সাথে সম্পৃক্তরা জানান- কিছু খাঁটি মানের চমচম টাংগাইলের পাঁচআনী বাজারের মিস্টির দোকানে পাওয়া গেলেও বাকিরা মূলতঃ পোড়াবাড়ির নাম ভাঙিয়ে বিক্রি করে খারাপ মানের চমচম। এসব দোকানি ও ব্যবসায়ী টাংগাইলসহ রাজধানী ঢাকাতেও দেদারসে ঠকাচ্ছে ক্রেতাদের। এতে নস্ট হচ্ছে পোড়াবাড়ির চমচমের ঐতিহ্য। দামেও রয়েছে বিস্তর ফারাক। ঢাকায় প্রতি কেজি চমচম ২০০টাকা থেকে শুরু করে বিক্রি হয় ৩৫০ টাকা পর্যন্ত। কিন্তু টাংগাইলে পোড়াবাড়ির চমচম বিক্রি হচ্ছে ১৮০ টাকায়।
আসল চমচমের উৎস
দামে যাই হোক, যারা এই চমচম রসিকরা ঠিকই ধরে ফেলেন ভেজাল। আর জানেন খাঁটি মানের চমচমের আসল ঠিকানাও। এ কারণে অনেক ক্রেতাই ঢাকার মিস্টির দোকানগুলোয় এখানে টাংগাইলের পোড়াবাড়ির চমচম পাওয়া যায় বিজ্ঞাপন লেখা থাকলেও ভেতরে ঢোকেন না। তারা তাদের পছন্দের চমচম আনেন স্বয়ং টাংগাইল গিয়ে অথবা কাউকে পাঠিয়ে।
পোড়াবাড়ি বাজারের আশে পাশের কয়েকটি বাড়িতে এখনও তৈরি হয় খাঁটি মানসম্পন্ন চমচম। এসব চমচম রাজধানী ঢাকা ছাড়াও বিভিন্ন শহরে সরবরাহ হয়। কিছু খাঁটি মানের চমচম পাওয়া যায় টাংগাইলের কালিবাড়ি বাজারের মিস্টির দোকানগুলোতে। খোকা ঘোষের জয়কালী মিস্টান্ন ভান্ডার এদের মধ্যে অন্যতম।
পোড়াবড়ির চমচম তৈরির অভিজ্ঞ কারিগরদের মতে- চমচমের গুণগত মান আর স্বাদ মূলত পানি এবং দুধের উপরই নির্ভরশীল। এখানে এই দুটি মৌল শর্ত পূরণ হয় বলে এ মিষ্টি স্বাদে, গন্ধে, তৃপ্তিতে অতুলনীয়। তাছাড়া এ চমচমের বিশেষ বৈশিষ্ট হলো- ভেতরেটা ফাঁপা। অন্য সব মিস্টিও মতো ভরাট নয়। আর চমচমের গায়ে জড়ানো মাওয়া হতে হবে একদম খাঁটি। এসবে কোন ছাড় দেয়া হলেই তার স্বাদ হয়ে যাবে ভিন্ন।
সর্বপরি পোড়াবাড়ির চমচম তৈরিতে রয়েছে বিশেষ টেকনিক বা কলাকৌশল। যা একমাত্র ঐ অঞ্চলের গুটি কয়েক পরিবারের লোকরাই ভালোভাবে রপ্ত করেছেন। ধরে রেখেছেন এখনো টাংগাইলের প্রাচীন ঐতিহ্য।
বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মিষ্টি ব্যবসায়ীরা পোড়াবাড়ির প্রস্তুতপ্রণালী ব্যবহার করে চমচম বানিয়েছে, কিন্তু এই মানের চমচম তৈরি করতে পারেননি।
এজন্যেই পোড়াবাড়ির চমচমের বিকল্প হয় না।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন