|
21 Jun 2012 11:00:52 PM Thursday BdST |
|
|
|
হারানো দিনের কথা মনে পড়ে যায়
আসাদুল হক খোকন, নিউজরুম এডিটর বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
 |
ছবি: স্ত্রীর সঙ্গে
|
ছোট বেলায় আমার আম্মার মুখে
নামটি প্রথম শুনি। আম্মা আমার নানাজানের গ্রামোফোন রেকর্ডে তার গান
শুনেছেন। নানাজান আব্বাস উদ্দীনের পাশাপাশি তার রেকর্ডও বাজাতেন। সেই থেকে
এই শিল্পী তার বিশেষ প্রিয়। আম্মার বিয়ের পর `গানবাজনা হারাম` ঘোষিত
শ্বশুর বাড়িতে এসে গান শোনা হয়নি অনেকদিন।
কিন্ত গানবাজনা বিষয়ে
কোনো আলাচনা উঠলেই আম্মা তার প্রিয় শিল্পীর কথা বলতেন। বলতেন- তার সুর,
কন্ঠ, আর গায়কী অসাধারণ। এভাবে নানাজানের এবং আম্মার পছন্দের শিল্পী মেহেদী
হাসান- এর নাম সেই শৈশবেই আত্মস্ত হয়ে গিয়েছিল।
 তার ভরাট কন্ঠের যাদু আম্মাকে সম্মোহীত করে রেখেছে বহুদিন।
এর
মাঝে ১৯৮৫ সালে সার্ক সম্মেলন উপলক্ষে বিশেষ আমন্ত্রণে ঢাকায় আসেন মেহেদী
হাসান। তার সে অনুষ্ঠান প্রচার করা হবে বাংলাদেশ টেলিভিশেন। আমাদের তখন
কোনো টিভি নেই। সারা গ্রামে একমাত্র টেলিভিশন রাজেন্দ্র ডাক্তারের বাড়ি।
১৪ ইঞ্চি সাইজের সাদা-কালো সে টিভিতে অনুষ্ঠান দেখতে প্রতিদিন জড়ো হয়
গ্রামের অনেক নারী-পুরুষ। ভালো কোনো অনুষ্ঠান থাকলে রাজেন্দ্র ডাক্তার
লোক পাঠিয়ে খবর দেন। সেবার খবর এলো- সন্ধ্যায় টিভিতে সার্ক অনুষ্ঠান
দেখাবে। পাকিস্তানের মেহেদী হাসান গজল পরিবেশন করবেন এই অনুষ্ঠানে। খবরটি
আম্মার কানে গেল। না দেখেই এতদিন যার গজল শুনে আম্মা আমাদের গল্প শুনিয়ে
এসেছেন, আজ তাকে সরাসরি দেখা যাবে (যদিও মিনিপর্দায়)-- এ সংবাদ যেন আম্মার
জন্য মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি।
(পরে এক সময় আব্বা আর রাজেন্দ্র ডাক্তারের কথোপকথনে বুঝতে পেরেছিলাম--আম্মার মত তারাও এই অচেনা গানওয়ালা লোকটার অন্ধভক্ত।)
যাহোক,
জোৎস্না রাতে আধো অন্ধকারে হ্যারিকেন নিয়ে আব্বা- আম্মা আর নাছোড়বান্দা
আমি অনেকটা পথ মাড়িয়ে ডাক্তার বাড়ি টিভি দেখতে গেলাম। গেলাম এতদিনে মনের
ভেতর গেঁথে থাকা মেহেদী হাসান নামের এক অপরিচিত শিল্পীকে চাক্ষুষ করতে।
রাজেন্দ্র
ডাক্তারের বাড়ি পৌঁছালাম। তারপর আকষ্মিক লোকজনের হৈচৈ থেমে গেলে বুঝতে
পারি অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। সাদা-কালো টিভির পর্দায় দেখতে পাই- শ্যামলা
মতো সাদা পাজামা পাঞ্জাবীর ওপর কালো হাতাকাটা কোট পরা শ্যামলা মতো
একলোক চোখ বন্ধ করে গান গাইছেন। ছোট করে ছেঁটে রাখা গোঁফওয়ালা লোকটির
একহাতের আঙুলগুলো হারমোনিয়ামের রিডে ছুটাছুটি করছে। যথানিয়মে শুধু ঠোঁট
নড়ছে। কোনো কসরৎ বা বাড়তি কষ্টের ছাপ নেই তার মুখে।
গভীর
ধ্যানমগ্ন শিল্পী উর্দু ভাষায় যা গাইছেন তাতে আমি যা ধরতে পারলাম তা হলো-
“রাফতা রাফতা ও মেরি...”। বাকি কথা অনভ্যস্ত কানে ঠিক ধরতে পারছি না। অন্য
যারা দর্শক আসনে তন্ময় হয়ে শুনছেন, আমার ধারণা, তারাও খুব একটা বুঝছেন না।
তবু পিনপতন নিরবতা! ডাক্তার মাঝে মাঝে আহ্ বলে চোখ বড় বড় করে টিভির দিকে
চাইছেন। আর বয়ষ্কদের কেউ কেউ শুধু গজলের সুরটুকু শুনেই চোখ মুছছেন নিরবে!
এই হলো মেহেদী হাসান। এই হলো শাহেনশাহ-ই-গজল মেহেদী হাসান।
সেই-ই
মূলত আমার গজল প্রেমের শু্রু। তারপর বড় হতে হতে একের পর এক আমাদের সামনে
নতুন সব গজল নিয়ে হাজির হয়েছেন তিনি। এরপর দীর্ঘদিন ক্যাসেট প্লেয়ারেই তার
কণ্ঠসুধা আমাদের মত ভীনদেশী ভক্তদের কান হয়ে মনকে আপ্লুত করেছে।
পাসপোর্ট-ভিসা আর সময় করতে পারা না পারার জটিলতায় আমাদের মত অতি সাধারণ
শ্রোতাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি তার কাছাকছি গিয়ে, সামনে বসে তার মখমলী কণ্ঠের
গান উপভোগ করা। তার পক্ষেও এখানে আসা খুব একটা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
পরে
জানতে পেরেছি, ১৯৮৫ সালে ঢাকায় আসেন তিনি। শ্রুতি রেকর্ডিং স্টুডিওতে
সাংবাদিক শরাফুল ইসলামের নেওয়া সাক্ষাৎকারে মেহেদী হাসান এ সম্পর্কে
বলেছিলেন- “একজন প্রকৃত কণ্ঠশিল্পীর জন্য পাসপোর্টটাই একটা বাঁধা। পাসপোর্ট
আমাদের সীমানা তৈরি করে দেয়। ফলে আমারই জন্মস্থান (ভারতের) রাজস্থানে যেতে
আমাকে ভিসা নিতে হয়। আমরা শিল্পী মানুষ। যখন খুশী চলে যাবো কনসার্ট করতে
কি পাকিস্তান, কি ভারত, কি বাংলাদেশ। অন্তত এই দেশগুলোতে আমাদের ভিসা
উন্মুক্ত করে দেওয়া দরকার। তাহলে আর যখন খুশী, যেখানে খুশী কনসার্ট করতে
চলে যেতে সমস্যা থাকবে না।”
কিন্তু তবু এই কাঁটাতার, এই সীমাবদ্ধতা কাটেনি!
ভারতীয়
সঙ্গীতের জীবন্ত কিংবদন্তী লতা মুঙ্গেশকরের দেয়া উপাধি- “দ্য ভয়েস অব গড”
আর প্রবাদতুল্য এই গজলশিল্পী সম্পর্কে অপর কিংবদন্তী শিল্পী ভূপেন
হাজারিকার মন্তব্য “মেহেদী হাসান আমাদের সঙ্গীতের পুরোহিত” তাকে কতটা উচ্চ
আসনে অধিষ্ঠিত করেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
গত ১৩ মার্চ পণ্ডিত
রবিশংকরের ভাষায়- ‘যার মাপকাঠি সাগরের মতো গভীর, আকাশের মতো বিশাল` সেই
প্রবাদতুল্য গজলশিল্পী মেহেদী হাসানকে আমরা হারিয়েছি। যিনি গজলকে আমাদের
দোরেগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছেন। আপাদমস্তক যিনি ছিলেন শুধুই শিল্পী আর গজলকে
আশ্রয় করে যিনি খুঁজে নিয়েছিলেন আপন ঠিকানা। সারাজীবন অন্য দশজন শিল্পীর মত
সঙ্গীতকে টাকার কাছে বিকিয়ে দেননি।
মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে, তার
গজলকে উদাহরণ করে নানামুখি আলোচনা হয়েছে। হচ্ছে এখনো। তাকে নিয়ে বাংলানিউজ
তথ্যবহুল কয়েকটি ফিচার প্রকাশ করেছে। কম-বেশি অন্য সংবাদপত্রগুলোও তার
গজলের উল্লেখযোগ্য তালিকা দিয়েছে।
কিংবদন্তী মোহাম্মদ রফির মুগ্ধতার একটি বিষয় হচ্ছে, বিশ্বের আরও লাখ-কোটি ভক্তের মত মেহেদীর গজল না শুনলে রাতে তারও ঘুম আসতো না।
কন্ঠের
ইন্দ্রজাল কতটা সুবিন্যস্ত ও সুবিস্তৃত হলে শ্রোতাকে তাও আবার রফি`র মতো
শ্রোতাকে শুধুমাত্র সুরের অদৃশ্য বাঁধনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বেঁধে রাখা যায়
তা সহজেই অনুমেয় বৈকি!
এ কারণেই, যার কন্ঠে গান ছিলো না সেই আমার
আব্বাকে মাঝে মাঝে তার গাওয়া বাংলা গজল “হারানো দিনের কথা মনে পড়ে যায়”
গুনগুন করে গাইতে শুনতাম।
পাকিস্তান সরকারের তমঘা-ই-ইমতিয়াজ ও
হিলাল-ই-ইমতিয়াজ খেতাব ছাড়াও নেপাল সরকারের কাছ থেকে গোরখা দক্ষিণাসহ বহু
খেতাব পেয়েছেন। সংগীতে অবদানের জন্য আজীবন বহু সম্মাননা ও পুরস্কার পেয়েছেন
তিনি।
তার মৃত্যুতে অসংখ্য ভক্তশ্রোতার মত আমারও স্বজন হারানোর
ব্যাথায় কান্না পেয়েছে। নাগরিক ব্যস্ততা আর লোকচক্ষুকে উপেক্ষা করে আরো
অনেকের মত আমিও উচিত কান্নাটুকু কাঁদতে পারিনি।
কিন্তু; মেহেদী
হাসানের গজলকে ভালোবেসে আমাদের মজনু ভাই যে আজীবন সংসারী হলেন না। স্কুল
জীবন থেকে শুরু করে আমৃত্যু যে মজনু ভাই মেহেদী হাসানের গজল গাইতেন, তার
গজল শুনে আবেগে অশ্রু বিসর্জন দিতেন। তার মতো করে গাইতে না পারায় আফসোসে
বুক চাপড়ে বলতেন- `ইস্ এইখানে কাজটা ঠিকমত হলো না`- এর খবর অনেকেই রাখতেন
না-- মেহেদী হাসানও জেনে জানলেন না। আমাদের সেই নির্লোভ মজনু ভাই
মেহেদী হাসানের অনেক আগেই চলে গেছেন না ফেরার দেশে। তবু সেই দৃশ্য এখনো
সতেজ যেন; ধ্যানমগ্ন মজনু ভাই মেহেদী হাসানের গজল শুনছেন নির্নিমেশ মুগ্ধ
গোপনতায়- “ঢাকো যত না নয়ন দু`হাতে শ্রাবণ মেঘ ঘুমাতে দেবে না।”
বাংলাদেশ সময় : ২২২৫ ঘণ্টা, ২১ জুন, ২০১২ |
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন